সরকার মো. আবুল কালাম আজাদ
অক্টোবর – ফেব্রুয়ারি: মাসওয়ারী করণীয় ও প্রযুক্তি প্রয়োগ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা
কেরালা সীম :
শীতকালীন একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী সবজি ফসল কেরালা সীম। এই সীমের শুঁটি কোমল, সুস্বাদু ও বাজারে চাহিদাসম্পন্ন হওয়ায় কৃষকের আয় বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখে।
কেরালা সীমের বৈশিষ্ট্যসমূহ:
কেরালা সীম বাংলাদেশের জনপ্রিয় এক জাতের সীম (বরবটি প্রজাতির)। এটি বিশেষ করে আগাম শীতকালীন ও শীত মৌসুমে চাষের উপযোগী। এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে —
ভারতের কেরালা রাজ্যে উদ্ভাবিত ও বাংলাদেশে পরীক্ষিত একটি উচ্চ ফলনশীল জাত।
স্থানীয়ভাবে “কেরালা সীম” বা “কেরালা বরবটি” নামে পরিচিত। গাছ লতানো প্রকৃতির, শক্ত ও দীর্ঘ লতা তৈরি করে। মাচা দিলে ফলন বেশি হয়। ফুল হালকা বেগুনি বা সাদা রঙের। ফল লম্বা, সবুজ ও নরম হয়। প্রতি গাছে প্রচুর ফুল ও ফল ধরে। বপনের ৫০–৬০ দিনের মধ্যে ফলন শুরু হয়। দীর্ঘ সময় ধরে ফলন দিতে থাকে (প্রায় ২–৩ মাস পর্যন্ত) হেক্টরপ্রতি গড়ে ১৫–১৮ টন ফলন পাওয়া যায়। যথাযথ পরিচর্যা ও সার ব্যবস্থাপনায় ফলন ২০ টন পর্যন্ত হতে পারে। সবুজ, লম্বা ও আকর্ষণীয়, ফলে বাজারে চাহিদা বেশি।
রান্নার পর নরম ও সুস্বাদু হয়, আঁশ কম। মোজাইক ভাইরাস, ছত্রাক ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ তুলনামূলক কম হয়। দ্রুত ফলনশীল ও দীর্ঘ সময় ফল দেয় বলে কৃষক ভালো লাভবান হয়।
এক মৌসুমে ৩–৪ বার ফসল সংগ্রহ করা যায়, যা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য লাভজনক। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত চাষের জন্য উপযুক্ত সময়।
তাছাড়া, এটি মাটিতে জৈব নাইট্রোজেন বৃদ্ধি করে, ফলে পরবর্তী ফসলের উৎপাদনেও সহায়ক ভূমিকা রাখে।
কেরালা সীম চাষ এখন শুধু মৌসুমি নয় — স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারে এটি হয়েছে উচ্চ লাভজনক টেকসই ফসল।
অক্টোবর মাস
জমি প্রস্তুতি ও বীজ বপন পর্ব:
কৃষকের করণীয়ঃ
আগের ফসল সরিয়ে জমি ভালোভাবে চাষ করুন ও মই দিন। প্রতি শতাংশে ৪০–৫০ কেজি পচা গোবর প্রয়োগ করুন। উন্নত জাত নির্বাচন করুন (বারি সীম-২, বারি সীম-৩, কেরালা সীম)।
প্রতি শতাংশে ২৫০–৩০০ গ্রাম বীজ সারিতে বপন করুন (সারি ৬০ সেমি, গাছ ৩০ সেমি দূরে)। বপনের পর হালকা সেচ দিন।
প্রযুক্তি প্রয়োগঃ
ট্রাক্টরে জমি তৈরি করুন।
মাটির pH ৬.০–৭.৫ নিশ্চিত করতে পরীক্ষা করুন।
নভেম্বর মাস
চারা পরিচর্যা ও মাচা স্থাপন পর্ব:
কৃষকের করণীয়ঃ
৭–১০ দিনের মধ্যে চারা গজানোর পর আগাছা পরিষ্কার করুন।
প্রথম কিস্তির ইউরিয়া (০.৪ কেজি/%) প্রয়োগ করুন।
গাছ ২০–২৫ সেমি হলে বাঁশ বা জালের মাচা তৈরি করুন।
পানি জমে না থাকার ব্যবস্থা করুন।
প্রযুক্তি প্রয়োগঃ
মাটির আর্দ্রতা সেন্সর ব্যবহার করে সেচ নিয়ন্ত্রণ।
নিম তেল (৫ মি.লি./লিটার পানি) স্প্রে করে পোকা প্রতিরোধ।
ড্রিপ ইরিগেশন ব্যবস্থায় ৫০% পানি সাশ্রয়।
ডিসেম্বর মাস
গাছের বৃদ্ধি ও ফুল ফোটা পর্ব :
কৃষকের করণীয়ঃ
লতা মাচায় সমানভাবে ছড়িয়ে দিন।
আগাছা পরিষ্কার করুন ও টিএসপি, এমওপি সারের অবশিষ্ট অংশ প্রয়োগ করুন।
ফুল আসার সময় দ্বিতীয় কিস্তির ইউরিয়া (০.৪ কেজি/%) দিন।
নিয়মিত হালকা সেচ দিন।
প্রযুক্তি প্রয়োগঃ
ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে ফল ছিদ্রকারী পোকার দমন।
IoT সেন্সরে মাটির তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা মনিটর।
জৈব সার (লিকুইড কম্পোস্ট বা বায়োফার্টিলাইজার) প্রয়োগ।
🌿 জানুয়ারি মাস
ফল ধরা ও সংগ্রহ পর্ব :
কৃষকের করণীয়ঃ
প্রথম ফল দেখা দিলে নিয়মিত সেচ দিন।
প্রতি ২–৩ দিন অন্তর শুঁটি সংগ্রহ করুন।
গাছের গোড়ায় তরল জৈব সার দিন।
ফল তোলার সময় লতা যেন না ভাঙে তা খেয়াল রাখুন।
প্রযুক্তি প্রয়োগঃ
নিমপাতা নির্যাসভিত্তিক জৈব কীটনাশক ব্যবহার।
সোলার ফগার মেশিনে স্প্রে করে সময় ও শ্রম সাশ্রয়।
🌿 ফেব্রুয়ারি মাস
শেষ পর্যায়ের সংগ্রহ ও ফসল-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা
কৃষকের করণীয়ঃ
শেষ পর্যায়ের শুঁটি সংগ্রহ করুন।
পুরনো ডাল ছেঁটে গাছকে নতুন শাখা বৃদ্ধিতে উৎসাহ দিন।
গাছ শুকিয়ে গেলে জমি পরিষ্কার করুন।
বাজারজাতের জন্য সীম বাছাই, গ্রেডিং ও প্যাকিং করুন।
পরবর্তী ফসলের জন্য চুন ও জৈব সার প্রয়োগ করুন।
প্রযুক্তি প্রয়োগঃ
সোলার ড্রায়ারে সীম শুকিয়ে সংরক্ষণ।
উৎপাদন তথ্য Digital Farm Record অ্যাপে সংরক্ষণ।
পরবর্তী ফসলের পরিকল্পনায় মাটি বিশ্লেষণ রিপোর্ট ব্যবহার।
কেরালা সীম চাষে স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যম
✅ প্রতি শতাংশে ৪০–৫০ কেজি ফলন
✅ পানি ও সার সাশ্রয় ৪০–৫০%
✅ পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থা
✅ কৃষকের গড় আয় বৃদ্ধি ২–৩ গুণ পর্যন্ত
লেখকঃ কেন্দ্রীয় সভাপতি: বাংলাদেশ পেশাজীবী ফেডারেশন
কৃষি লেখক ও কথক : বাংলাদেশ বেতার
উপদেষ্টা: দৈনিক গ্রামীণ কৃষি