বুধবার, অক্টোবর ১৫, ২০২৫
- বিজ্ঞাপন -
হোম ধর্মমহামহিমান্বিত রজনী লাইলাতুলকদর

মহামহিমান্বিত রজনী লাইলাতুলকদর

গ্রামীণ কৃষি ডেস্কঃ ‘লাইলাতুল কদর‎‎’ এর অর্থ অতিশয় সম্মানিত ও মহিমান্বিত রাত বা পবিত্র রজনী। আরবি ভাষায় ‘লাইলাতুল’ অর্থ হলো রাত্রি বা রজনী এবং ‘কদর’ শব্দের অর্থ সম্মান, মর্যাদা, মহাসম্মান। এ ছাড়া এর অন্য অর্থ হচ্ছে; ভাগ্য, পরিমাণ ও তাকদির নির্ধারণ করা।

ইসলাম ধর্ম অনুসারে, এ রাতে মহানবী (সা.) এর সম্মান বৃদ্ধি করা হয় এবং মানবজাতির ভাগ্য পুনর্নির্ধারণ করা হয়।তাই প্রতিটি মুসলমানের কাছে এই রাত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও মহাসম্মানিত হিসেবে পরিগণিত। পবিত্র কুরআন মাজীদের বর্ণনা অনুসারে, আল্লাহ এই রাত্রিকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছেন এবং এই একটি মাত্র রজনীর উপাসনা হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও অধিক সওয়াব অর্জিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।প্রতিবছর মাহে রমজানে এই মহিমান্বিত রজনী লাইলাতুল কদর মুসলিমদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে।লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব আল্লাহ এ রাতকে সকল রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়েছেন।পবিত্র কুরআনে এ রাতকে প্রশংসার সাথে উল্লেখ করেছেন আল্লহ নিজেই। তিনি তাঁর কালাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইরশাদ করেন, নিশ্চয় আমি এটি নাজিল করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী।সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়, আমার নির্দেশে। নিশ্চয় আমি রাসুল প্রেরণকারী।তোমার রবের কাছ থেকে রহমত হিসেবে;নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। যিনি আসমানসমূহ, জমীন ও এ দুয়ের মধ্যবর্তী সব কিছুর রব; যদি তোমরা দৃঢ় বিশ্বাস পোষণকারী হও। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনিই জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু দেন। তিনি তোমাদের রব এবং তোমাদের পিতৃ পুরুষদের রব।

আল্লাহ ইরশাদ করেনঃ ১.حم হা-মী-ম্ ~ হা-মীম।

২.وَالْكِتَابِ الْمُبِينِ আরবি উচ্চারণঃ ওয়াল কিতা-বিল্ মুবীন। বাংলা অনুবাদঃ সুস্পষ্ট কিতাবের কসম!

৩,। إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ আরবি উচ্চারণঃ ইন্না য় আন্ যাল্না-হু ফী লাইলাতিম্ মুবা-রকাতিন্ ইন্না-কুন্না- মুনযীরীন্।বাংলা অনুবাদঃ নিশ্চয় আমি এটি নাযিল করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী।

৪। فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيم আরবি উচ্চারণঃ ফীহা-ইয়ুফরকু কুল্লু আমরীন্ হাকীম্। বাংলা অনুবাদঃ সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়।

৫।أَمْرًا مِنْ عِنْدِنَا إِنَّا كُنَّا مُرْسِلِينআরবি উচ্চারণঃ আমরাম্ মিন্ ই’ন্দিনা-; ইন্না-কুন্না মুরসিলীন্ বাংলা অনুবাদঃ আমার নির্দেশে। নিশ্চয় আমি রাসূল প্রেরণকারী।

৬।رَحْمَةً مِنْ رَبِّكَ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ আরবি উচ্চারণঃ রহমাতাম্ মির রব্বিক্; ইন্নাহূ হুওয়াস্ সামী উ’ল্ ‘আলীম্। বাংলা অনুবাদঃ তোমার রবের কাছ থেকে রহমত হিসেবে; নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

৭।رَبِّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا إِنْ كُنْتُمْ مُوقِنِينَ আরবি উচ্চারণঃ রব্বিস্ সামা-ওয়া-তি অল্ র্আদ্বি অমা-বাইনাহুমা- ইন্ কুন্তুম্ মূক্বিনীন্।বাংলা অনুবাদঃ যিনি আসমানসমূহ, যমীন ও এ দু‘য়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর রব; যদি তোমরা দৃঢ় বিশ্বাস পোষণকারী হও।

৮। لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ يُحْيِي وَيُمِيتُ رَبُّكُمْ وَرَبُّ آبَائِكُمُ الْأَوَّلِينَআরবি উচ্চারণঃ লা য় ইলা-হা ইল্লা-হুওয়া ইয়ুহ্য়ী অইয়ুমীত্; রব্বুকুম্ অরব্বু আ-বা-য়িকুমুল্ আওয়্যালীন্। বাংলা অনুবাদঃ তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই; তিনিই জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু দেন। তিনি তোমাদের রব এবং তোমাদের পিতৃপুরুষদের রব।

৯।بَلْ هُمْ فِي شَكٍّ يَلْعَبُونَ আরবি উচ্চারণঃ বাল্ হুম্ ফী শাক্কিঁই ইয়াল্‘আবূন্। বাংলা অনুবাদঃ তারা বরং সন্দেহের বশবর্তী হয়ে খেলতামাশা করছে।[সূরা দুখানঃ আয়াত :৩-৮]বরকতময় রজনী হলো লাইলাতুল কদর। আল্লাহ বরকতময় বলে অভিহিত করেছেন। কারণ এ রাতে রয়েছে যেমন বরকত তেমনি কল্যাণ ও তাৎপর্য। বরকতের প্রধান কারণ হল এ রাতে আল-কুরআন নাজিল হয়েছে। এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-সিদ্ধান্ত লওহে মাহফুজ থেকে ফেরেশতাদের হাতে অর্পণ করা হয় বাস্তবায়নের জন্য। এ রাতের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হলো আল্লাহ তাআলা এ রাত সম্পর্কে একটি পূর্ণ সূরা অবতীর্ণ করেছেন। যা কিয়ামত পর্যন্ত পঠিত হতে থাকবে।

আল্লাহ আলা ইরশাদ করেছেনঃ(১إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِউচ্চারণঃ ইন্নাআনঝালনা-হু ফী লাইলাতিল কাদর।অর্থঃ আমি একে নাযিল করেছি শবে-কদরে। (২وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِউচ্চারণঃ ওয়ামাআদরা-কা-মা-লাইলাতুল কাদর। অর্থঃ শবে-কদর সমন্ধে আপনি কি জানেন? (৩لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍউচ্চারণঃ লাইলাতুল কাদরি খাইরুম মিন আলফি শাহর।অর্থঃ শবে-কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।(৪تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمْرٍউচ্চারণঃ তানাঝঝালুল মালাইকাতুওয়াররুহু ফীহা-বিইযনি রাব্বিহিম মিঅর্থঃ এতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে।(৫سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِউচ্চারণঃ ছালা-মুন হিয়া হাত্তা-মাতলা’ইল ফাজর।অর্থঃ এটা নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।[সূরা কদর: আয়াত: ১-৫]আল-কুরআনে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি লাইলাতুল কদর কোন রাত। তবে কুরআনের ভাষ্য হলো লাইলাতুল কদর রমজান মাসে। কিয়ামত পর্যন্ত রমজান মাসে লাইলাতুল কদর অব্যাহত থাকবে। এবং এ রজনী রমজানের শেষ দশ দিনের মধ্যে হবে বলে সহিহ হাদিসে এসেছে। এবং তা রমজানের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে হাদিসে এসেছে।হাদিসে আছে, ‘রমাযানের শেষ দশ দিনে তোমরা কদরের রাত তালাশ করো। ’ (বোখারি ২০২০ মুসলিম :১১৬৯)এবং রমজানের শেষ সাত দিনে লাইলাতুল কদর থাকার সম্ভাবনা অধিকতর। যেমন হাদিসে আছে, তোমরা রমাযানের শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে কদরের রাত খোঁজ করো। (বোখারি: ২০১৭)অধিকতর সম্ভাবনার দিক দিয়ে প্রথম হলো রমজান মাসের সাতাশ তারিখ। দ্বিতীয় হল পঁচিশ তারিখ। তৃতীয় হল ঊনত্রিশ তারিখ। চতুর্থ হল একুশ তারিখ। পঞ্চম হল তেইশ তারিখ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ রাতকে গোপন রেখেছেন আমাদের উপর রহম করে। তিনি দেখতে চান এর বরকত ও ফজিলত লাভের জন্য কে কত প্রচেষ্টা চালাতে পারে। লাইলাতুল কদরে আমাদের কর্তব্য হলো বেশি বেশি নিজের জন্য আত্মীয় স্বজনদের জন্য দোয়া করলে আল্লাহ তা কবুল করেন।

লাইলাতুল কদর উপলক্ষে আমাদের করণীয়:ক. কদরের ফজিলত পাওয়ার উদ্দেশ্যে কিছু নফল ইবাদত করা, নফল নামাজ আদায় করা। কুরআন তেলাওয়াত করা, তাছবীহ তাহলীল পাঠ করা কর্তব্য। দুই দুই রাকআত করে নফলের নিয়ত করে যেকোনো সূরাই সূরা ফাতেহার সঙ্গে মিলিয়ে নামাজ পড়া যাবে। তাতে কোনো অসুবিধা নেই। উত্তম হলো নফল নামাজ ধীরে সুস্থে লম্বা লম্বা ক্বেরাত দিয়ে পড়া এবং ধীরস্থিরে রুকু-সিজদা আদায় করা।খ. লাইলাতুল কদর হলো বছরের শ্রেষ্ঠ রাত। এ রাতের শ্রেষ্ঠ দোয়া হলো ক্ষমা চাওয়ার দোয়া। এ রাতে মহানবী (সা.) ক্ষমা চাওয়ার দোয়া শিক্ষা দিলেন যে, তুমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাও, ক্ষমা পাওয়ার জন্য দোয়া করো। হাদীস শরীফে আছে হযরত আয়েশা (রা.) মহানবী (সা.) কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ইয়া রাসূল আল্লাহ! যদি আমি বুঝতে পারি শবে কদর কোন রাত, তাহলে ঐ রাতে আমি কি বলব? আল্লাহর কাছে কি চাইব? প্রিয় নবী (সা.) তদুত্তরে বলেন তুমি বলবে, ‘হে আল্লাহ আপনি বড়ই ক্ষমাশীল। ক্ষমা করতে আপনি ভালবাসেন, তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন। ’ আরবি দোয়া হলো- আল্লাহুম্মা ইন্নাকা, আফুউন তুহেববুল আফওয়া, ফাওফু আন্নি (ইবনে মাজাহ)।কেউ যদি জীবনে অনেক কিছু পায় কিন্তু ক্ষমা না পায়, তাহলে তার জীবন ব্যর্থ। তাই এ রাতে অন্তরকে নরম করে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়ার পূর্বে খাঁটি দিলে তওবা ইস্তেগফার করতে হয়।

খাঁটি তওবার চারটি শর্ত:১. পূর্বের গুনাহ থেকে ফিরে আসা বা গুনাহ ছেড়ে দিতে হবে;২. গুনাহর জন্য মনে মনে অনুতপ্ত হতে হবে যে, আমি বড়ই অন্যায় করেছি;৩. ভবিষ্যতে ওই গুনাহ আর করবো না বলে মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হবে;৪. বান্দাহর কোনো হক নষ্ট করে থাকলে যথাসাধ্য সে হক আদায় করে দিতে হবে।গ. এ রাতের আরেকটি আমল ফুকাহায়ে কিরামগণ বলেছেন যে, এ রাতে ইবাদাতের পূর্বে যদি কেউ গোসল করে নিতে পারে তার সেটাই উত্তম। উক্ত আমলগুলো শুধু ২৭ রমজান নয় বরং রমজানের শেষ দশ দিনের প্রত্যেক বেজোড় রাতে শবেকদর তালাশ করতে হবে। এজন্য মহানবী (সা.) রমজানের শেষ দশ দিনে ইতেকাফ করতেন। আর উম্মতের জন্য শরীয়তে ইতেকাফের বিধান কিয়ামত পর্যন্ত জারি রেখে গিয়েছেন যেন তারা ইতেকাফের মাধ্যমে লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব দিয়ে প্রত্যেকটি বেজোড় রাতে এবাদত করতে পারেন। আল্লাহ তায়ালা লাইলাতুল কদরে কুরআন নাজিল করেন। এ রাত বছরে একবার আসে আর চলে যায়। কিন্তু এ রাতের মহান নিয়ামত কুরআন মানব সমাজেই বিরাজমান থাকে চিরদিন। মানব জীবনে সাফল্য এই কুরআনের আমলের উপরই নির্ভরশীল। এই রাতের মর্যাদা মূল্যায়ন তখনই যথার্থ হবে। যখন আমরা কুরআনের নির্দেশিত পথে চলবো, আর কুরআনের বাহক মুহম্মদ (সা.) এর পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য করবো।

এ রাতের সর্বাপেক্ষা মহৎ প্রাপ্তি হলো কুরআনের হক আদায় করা এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে কুরআন প্রদর্শিত পথে পরিচালিত করার জন্য নিজেদেরকে সর্বদা প্রস্তুত করা।আল্লাহ যেন সবাইকে লাইলাতুল কদর তালাশ করার তৌফিক দান করুন। সে অনুয়ারী আমল করার তৌফিক এনায়েত করুন। আমিন। আমিন।।

[সংগৃহিতঃ সূত্র- ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।]

আপনার মতামত দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

Most Popular

Recent Comments