সরকার মো. আবুল কালাম আজাদ
দুধ মানুষের পরিপূর্ণ খাদ্য—এতে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ও খনিজ উপাদান থাকে যা শরীরের বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধে অপরিহার্য। কিন্তু বর্তমানে বাজারে বিক্রিত অনেক দুধেই পানি, স্টার্চ, ডিটারজেন্ট, ইউরিয়া, ফরমালিনসহ নানা ভেজাল উপাদান মেশানো হচ্ছে। এতে দুধের পুষ্টিমান নষ্ট হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে কিডনি, লিভার, স্নায়ুতন্ত্র এমনকি ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়ে।
ঘরে বসেই দুধের ভেজাল শনাক্তের কিছু নির্ভরযোগ্য ও পরীক্ষিত উপায়:-
১. দুধে পানি মেশানো চেনার সহজ কৌশল :
পদ্ধতি: এক ফোঁটা দুধ কাচের পাত্রে ফেলুন ও সামান্য কাত করুন।
ফলাফল:
যদি ফোঁটা দ্রুত গড়িয়ে যায় বা ছড়িয়ে পড়ে — তাতে পানি মেশানো আছে।
খাঁটি দুধ ঘন ও আঠালো, সহজে গড়ায় না।
বৈজ্ঞানিক কারণ: খাঁটি দুধে প্রোটিন ও ফ্যাট কণার ঘনত্ব বেশি থাকে, যা তার সান্দ্রতা ধরে রাখে।
২. দুধে ডিটারজেন্ট বা সাবানজাতীয় পদার্থ শনাক্তকরণ:
পদ্ধতি:
এক চা চামচ দুধের সঙ্গে সমপরিমাণ পানি মিশিয়ে ঝাঁকান।
ফলাফল:
অতিরিক্ত ফেনা তৈরি হয়ে যদি দীর্ঘক্ষণ স্থির থাকে, তবে ডিটারজেন্ট বা সাবান মেশানো আছে।
স্বাস্থ্যঝুঁকি: পাকস্থলীর ঝিল্লি ক্ষতিগ্রস্ত করে, গ্যাস্ট্রিক, আলসার ও ত্বকজনিত সমস্যা সৃষ্টি করে।
৩. দুধে স্টার্চ (আলু / আটা / চালগুঁড়া) মেশানো চেনা:
পদ্ধতি:
দুধে কয়েক ফোঁটা আয়োডিন সলিউশন দিন।
ফলাফল: নীলচে-বেগুনি রঙ ধারণ করলে বুঝবেন তাতে স্টার্চ রয়েছে।
স্বাস্থ্যঝুঁকি: অতিরিক্ত স্টার্চ হজমে সমস্যা, গ্যাস ও রক্তে শর্করা বৃদ্ধি করে।
বৈজ্ঞানিক কারণ: আয়োডিন স্টার্চের সঙ্গে বিক্রিয়া করে নীল রঙ উৎপন্ন করে।
৪. দুধে ইউরিয়া বা ক্ষতিকর রাসায়নিক শনাক্তকরণ:
পদ্ধতি:
দুধে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস বা ভিনেগার দিন।
ফলাফল:
দুধ না ফাটলে বুঝবেন ইউরিয়া বা রাসায়নিক সংরক্ষণকারী মেশানো আছে।
কারণ: ইউরিয়া প্রোটিনের জমাট বাঁধা রোধ করে, ফলে দুধ ফাটে না।
স্বাস্থ্যঝুঁকি: কিডনি বিকলতা, লিভার সমস্যা ও হরমোন ভারসাম্য নষ্ট করে।
৫. দুধে চিনি বা গ্লুকোজ মেশানো শনাক্ত
পদ্ধতি:
এক ফোঁটা দুধে আয়োডিন টিঞ্চার দিন।
ফলাফল: নীলচে রঙ ধারণ করলে তাতে গ্লুকোজ বা চিনি মেশানো আছে।
স্বাস্থ্যঝুঁকি: ডায়াবেটিস ও স্থূলতা বৃদ্ধি করে।
৬. দুধে সিন্থেটিক বা কৃত্রিম দুধ চেনার উপায়:
পদ্ধতি:
সামান্য দুধ গরম করুন।
ফলাফল:
পেট্রোল, প্লাস্টিক বা রাসায়নিকের মতো গন্ধ পেলে বুঝবেন এটি সিন্থেটিক দুধ।
বৈজ্ঞানিক কারণ: কৃত্রিম দুধে স্যাপোনিন, বোরিক অ্যাসিড, ডিটারজেন্ট ও ইউরিয়া মিশিয়ে ঘনত্ব তৈরি করা হয়।
স্বাস্থ্যঝুঁকি: দীর্ঘমেয়াদে লিভার বিকলতা, ক্যানসার ও শিশুর বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
৭. দুধে রঙ, ঘনত্ব ও স্বাদ পর্যবেক্ষণ:
খাঁটি দুধ হালকা ক্রিমি-হলদেটে ও ঘন।
ভেজাল দুধ সাদা, পাতলা ও চকচকে।
মুখে নিলে সাবান বা তেতো স্বাদ পাওয়া গেলে ভেজাল সন্দেহ করুন।
৮. দুধে ফরমালিন বা সংরক্ষণকারী পদার্থ শনাক্ত
পদ্ধতি:
দুধ কিছুক্ষণ রোদে রেখে দিন।
ফলাফল: দুধ দীর্ঘ সময়েও টক না হলে বা ফাটলে দেরি হলে তাতে ফরমালিন মেশানো আছে।
স্বাস্থ্যঝুঁকি: ফরমালিন ক্যানসার, লিভার ও স্নায়ুতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি করে।
জনস্বাস্থ্য দৃষ্টিকোণ:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে, ভেজাল দুধে থাকা রাসায়নিক উপাদানসমূহ—
শিশুদের বুদ্ধিবিকাশ ও শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে,
প্রাপ্তবয়স্কদের কিডনি, লিভার ও হরমোনজনিত রোগ বাড়ায়,
দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসার ও বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি তৈরি করে।
🔶 সতর্কতা ও প্রতিরোধ:
১. দুধ অবশ্যই সিদ্ধ করে পান করুন।
২. বিশ্বস্ত উৎস বা ব্র্যান্ড থেকে দুধ সংগ্রহ করুন।
৩.মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ ও প্যাকেটের সিল যাচাই করুন।
৪. প্রয়োজনবোধে স্থানীয় খাদ্য পরীক্ষাগারে নমুনা পরীক্ষা করুন।
৫.শিশুর জন্য দুধ ব্যবহারে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করুন।
খাঁটি দুধ শরীরের পুষ্টির আধার, কিন্তু ভেজাল দুধ ধীরে ধীরে বিষে পরিণত হয়। সচেতনতা ও সতর্কতা বজায় রাখাই একমাত্র সুরক্ষা।
লেখকঃ কেন্দ্রীয় সভাপতি - বাংলাদেশ পেশাজীবী ফেডারেশন
কৃষি লেখক ও কথক - বাংলাদেশ বেতার
উপদেষ্টা: দৈনিক গ্রামীণ কৃষি, দৈনিক সংবাদ প্রতিক্ষণ