সালমা তালুকদার
দুটো ফোন আসে গত দুইদিন। একজনকেও চিনি না। একটি আসে সাভার থেকে আরেকটি মনে নেই। সম্ভবত টাঙ্গাইল থেকে। দুটো ফোন দুই জায়গা থেকে হলেও সমস্যার ধরন একই। প্রথমেই জিজ্ঞেস করেছেন, আমি সালমা তালুকদার কিনা। আর স্পেশাল শিশু নিয়ে কাজ করি কিনা। আমি হ্যা সম্মতি দিলে বললেন, স্পেশাল শিশুর ধরন সম্পর্কে জানতে আপনাকে ফোন দিয়েছি। অমুক নামের একজন বলেছেন, আপনি সঠিক গাইড লাইন দিতে পারবেন। যাদের নাম ওনারা বলেছেন তাদেরও আমি চিনি না। যাই হোক নাম্বার তো আমার পাবলিক। যে কেউ পেতে পারে। ওটা কোন সমস্যা নয়।
সমস্যা হচ্ছে, আমি আতঙ্কিত তাদের সমস্যা শুনে। দুটো ছেলের কথা দু’জন বললেন। একটি ছেলের বয়স ১৯ বছর। আরেকটি ছেলের বয়স ২১ বছর। সমস্যার ধরন প্রায় একই। দুই একটা জায়গায় কেবল অমিল। সমস্যা গুলো হলো, আনমনা থাকে….হাত পা ঠিক থাকলেও হাঁটা চলায় সমস্যা….নার্ভাস ফিল করে….কথা ভুলে যায়। আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এটা কি অটিজমের লক্ষন কিনা! দুজনেরই প্রথম প্রশ্ন এটাই ছিল।
যা শুনে আমি খুব অবাক হয়েছি। এখন সমাজের মানুষ অটিজম সম্পর্কে সচেতন হয়েছে। মানে অটিজম শিশুদের আচরণ সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানে। আরকিছুই জানে না। নইলে সামনে এসএসসি পরীক্ষা দিবে আর এইচএসসি পাশ করা ছেলে দুটো সম্পর্কে তাদের প্রথম প্রশ্ন থাকতো না যে, ওরা অটিজম আক্রান্ত কিনা। কতটা জরুরি হয়ে গেছে অটিজম সম্পর্কে অথবা বিশেষ শিশু সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে সমাজের মানুষকে জানানো। এ তো গেল একটা বিষয়।
অন্য বিষয়টা এতটাই আমাকে নাড়া দিয়েছে যে রাতের ঘুমটা আর হলো না। ছেলে দুটোর অভিভাবকের সাথে দীর্ঘ সময় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে একটা পরামর্শই আমি দিয়েছি। সেটা হলো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একজন নিউরোলজিস্টের কাছে যেতে। আর ওনার পরামর্শে কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করতে।
এই ঘটনাগুলোর পেছনে সাধারনভাবে আমার যেটা মনে হয়েছে সেটা শেয়ার করার জন্যেই আজকের এই লেখা। এত বড় ছেলেগুলো যারা স্কুলের গন্ডি পার হবার অপেক্ষায় ছিল। কলেজের গন্ডি অলরেডি পার হয়ে গেছে। এদের এখন কেন এমন আচরণ হবে! আপনারাও কি আমার মত ভাবছেন কিনা জানি না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, এটা কভিড পরিস্থিতির আরেকটা ভয়াবহ রুপ। আমি জিজ্ঞেস করে জেনেছি ওরা ড্রাগ নেয়নি। অবশ্য এটা অভিভাবকদের ভাষ্য। কারন বেশির ভাগ অভিভাবকেরা নিজেদের সন্তানের বদলে যাওয়া চরিত্র সম্পর্কে অজানা থাকেন। তারা জানেনই না সন্তান তার বড় হয়ে গেছে। অনেককিছুর হয়তো উল্টো মানে তৈরি করে ভুল পথে এগুচ্ছে। অথবা বিশ্ব যে এখন হাতের মুঠোয় এটা তারা ভুলে যান। একটা স্মার্ট ফোনের বদৌলতে পুরো বিশ্বের কোথায় কি হচ্ছে সেটা যেমন জানা যায়। তেমনি দেখতে দেখতে খারাপ ভালো বুঝতে না পেরে বেশিরভাগ মানুষ খারাপটাই গ্রহন করে।
যেখানে মধ্যবয়স্ক পুরুষদের চরিত্র দেখলে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হই আমরা। সেখানে এই সব উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের থেকে কি আশা করবো। একজন বাবা মা অথবা অভিভাবকদের কখনোই তার সন্তানের হাত ছাড়া উচিত নয়। এবং যতটা সম্ভব চোখে চোখে রাখা উচিৎ। ঐ দুটো ছেলে সত্যি ড্রাগ নেয় কিনা আমি জানি না। শুধু এতটুকু মনে হয়েছে ওরা ঘরে বসে মোবাইলে আসক্ত এবং ফলশ্রুতিতে শরীরে ও মস্তিষ্কে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হয়েছে।
আমাদের মস্তিষ্ক দ্বারা সকল কিছু নিয়ন্ত্রিত হয়। সেই জায়গায় মস্তিষ্ককে যদি সারাক্ষণ বিভিন্ন বিষয় যা কিনা আমরা রিসিভ করছি ইন্টারনেট থেকে তা দিয়ে ব্যস্ত রাখি। তাহলে আমাদের মস্তিষ্ক সুস্থ চিন্তা করার স্বাভাবিক ক্ষমতা হারায়। কারন ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইড গুলোতে বিভিন্ন রকম ঘটনা রটনা ঘুরে বেড়ায়। যা দেখে বা শুনে খুব দ্রুত মানুষ নিজের মধ্যে ধারন করছে।
বিবেক কাজে লাগিয়ে খারাপ ভালো আলাদা করছে না অনেক সময়। আমি মনে করি, ড্রাগের মতোই ভয়াবহ নেশা হচ্ছে ইন্টারনেট। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে যদি ইন্টারনেট ব্যবহার না করা হয়, তাহলে এটা মস্তিষ্কের উপর বেশ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এবং মস্তিষ্ক তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারায়। ঠিক যেমন করে যে কোন ড্রাগ গ্রহন করলে শরীর তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারায়।
ভেবে দেখেন দুটো কিন্তু একই রকম কাজ করে। আর বেশি কথায় না যাই। শুধু এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক দিয়ে কিছু উপদেশ দিতে চাই। আপনার উঠতি বয়সের শিশুটি কি করছে একটু খেয়াল করেন। সারাদিন আপনি যে কাজেই ব্যস্ত থাকেন না কেন তার কাছে গিয়ে একটু সময় করে বসেন। তার মনের কথা মুখে ফুটে উঠেছে কিনা খেয়াল করেন।
বয়ঃসন্ধিকালটা ভালো না। তার উপর এই করোনা মহামারীর জন্য লকডাউনে ঘরবন্দী। বন্ধুবান্ধবদের সাথে যোগাযোগটাও ইন্টারনেটেই। মোবাইল না দিয়েও পারবেন না। কিন্তু একবার ভাবেন তো, আপনার সন্তানটি কভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতেও পারে আবার নাও যেতে পারে।
কিন্তু লাগাতার ইন্টারনেট ব্যবহারের কারনে মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটলে সেটার প্রভাব শরীরেও যদি পরে সেই সন্তানকে নিয়ে আপনি সারাজীবন পস্তাবেন না? তাই এখনই সতর্ক হওয়া জরুরি। আপনার শত ব্যস্ততার সাথে কিছু ব্যস্ততা সন্তানকেও দিন। ঘরের কাজে তাকে ইনভলভ করেন। গল্প করেন। ইনডোর গেমস গুলো খেলেন। সে যদি একা থাকতে চায় কিছু সময়ের জন্য তাকে একা ছেড়ে দিন। তারপর বোঝার চেষ্টা করুন ঐ একা থাকার সময়টুকুতে সে কি করেছে। তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করুন। মিথ্যা বললে সরাসরি তাকে পাকড়াও না করে ঘুরিয়ে মিথ্যা বলার পরিনতি বোঝান। তার বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করেন। তার সাথে আপনিও ইন্টারনেটে কানেক্টেড থাকেন। আপনাকে গোপন করে তার আইডিতে কিছু দিলে সেটাও বোঝার চেষ্টা করেন। এখন একটা বিষয় বড়দের মধ্যেও দেখা যায়। অবশ্য ইন্টারনেট এটা তৈরি করে দিয়েছে। আপনি একটা পোস্ট চাইলেই নির্দিষ্ট কাউকে গোপন করে দিতে পারেন।
আমি মনে করি এটা অন্যায়। অপশন দুটো থাকা উচিৎ। একটি পাবলিক। অন্যটি ফ্রেন্ড। হয় আপনি পাবলিকলি কিছু শেয়ার করবেন। নয়তো বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন। যাকে যাকে আপনার পোস্টটি দেখাতে চান না সে আপনার বন্ধুলিস্টেই থাকবে কেন! এই বিষয়টি আপনার সন্তানকে বোঝান। সবশেষ কথা হচ্ছে, কেবল জন্ম দিলেই বাবা, মা হওয়া যায় না। সন্তানের প্রতিটা বিষয় আপনার নখদর্পনে থাকতে হবে। আবার ভুল ভাবে আমার কথার মানে অন্যদিকে নিয়ে যাবেন না প্লিজ। যেমন সন্তানের দিকে কিছু বাবা মা এমনই খেয়াল করেন যে, সন্তানের বিয়ের পরও সেটা ছাড়েন না। ওটা আবার করা যাবে না। তখন সন্তান পরামর্শ চাইলে কেবল দিতে হবে। সেটা আবার অন্য বিষয়। অন্যদিন এটা নিয়ে বিষদ আলোচনায় আসবো ইনশাআল্লাহ।
সৃষ্টিকর্তা প্রতিটা অভিভাবককে ধৈর্য্য দান করুন এবং আমাদের সন্তানদের মঙ্গল করুন। আমিন।
করোনা ভাইরাসের কারণে বদলে গেছে আমাদের জীবন।আনন্দ-বেদনায়,সংকটে, উৎকণ্ঠায় কাটছে সময়।আপনার সময় কাটছে কিভাবে? লিখতে পারেন গ্রামীণ কৃষিতে। আজই পাঠিয়ে দিন – grameenkrishi2016@gmail.com
**মতামতের জন্য সম্পাদক / প্রকাশক দায়ী নয়।