অধ্যাপক ড. হোসেন মনসুর
প্রাচীনকাল থেকেই সাততারা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে। সাততারা বা সাতবোন তারাগুচ্ছ অ্যান্ড্রোমেডা গ্যালাক্সির নীচে প্লায়েডিস তারাপুঞ্জে অবস্থিত। আকাশে তাকালে একগুচ্ছ তারাপুঞ্জ আকাশে মিটমিট করে জ্বলে। এগুলো মধ্যম বয়সী ‘বি’ গ্রেডের তারকা মন্ডলি টোরেস তারাপুঞ্জে অবস্থিত । আমাদের স্থানীয় ভাষায় ‘টিক্কাপুটির ঝাঁক’ বলা হয়ে থাকে। আগে শরতকালে চলনবিলের পানি থাকত অত্যন্ত স্বচ্ছ, যেন প্রাকৃতিক অ্যাকোরিয়াম। নৌকা নিয়ে বিলে গেলে স্বচ্ছ পানিতে ছোট-বড় অসংখ্য মাছের ঝাঁক এক অপুর্ব দৃশের অবতারণা করতো। তাই হয়তো আকাশের তারাপুঞ্জকে টিক্কাপুটির ঝাঁক বলা হয়েছে। কালপুরুষকে চিনে আকৃতি মিলাতে অনেকের কষ্ট হলেও সাততারা খুঁজে বের করতে কারোর কোন অসুবিধা হয় না, যদিও তারাগুলো অস্পষ্ট বা ঝাপসা। ভারতীয় পৌরাণিক শাস্ত্রে সাততারাকে সপ্তর্ষি বলা হয়েছে। ব্রহ্মার মানসপুত্ররূপে খ্যাত এই সাত ঋষিশ্রেষ্ঠ হলেনঃ মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু ও বশিষ্ঠ। তাঁরা শিবের সাথে একত্রে পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকেন।
সপ্তর্ষি তারাপুঞ্জে আলফেরাজ (আলফা আন্ড্রোমেডা) সবচেয়ে উজ্জ্বল নীল নক্ষত্র। পৃথিবী থেকে আলফেরাজের দুরত্ব প্রায় ৯৭ আলোকবর্ষ। আলফেরাজ পেগাসাস চতুঋভূজের এক কোনায় অবস্থিত। আগে পেগাসাস তারাপুঞ্জের একটা অংশ হিসেবেই ধরা হত। আলফেরাজ সূর্যের চেয়ে ৩.৬ গুণ ভারী এবং ২০০ গুণ উজ্জ্বল। আলফেরাজ আরবি শব্দ থেকে এসেছে, এর অর্থ হল ‘ঘোড়ার নাভি’। আন্ড্রোমেডা তারাপুঞ্জে আলফেরাজকে পৌরাণিক আন্ড্রোমেডা রাজকন্যার মাথাকে ইঙ্গিত করে।
আন্ড্রোমেডা তারাপুঞ্জে দ্বিতীয় উজ্জ্বল তারা হল মিরাক (বা বিটা আন্ড্রোমেডা)। টেলিস্কোপ বা বাইনোকুলার ছাড়াই পরিস্কার রাতের আকাশে লাল তারাটি চোখে পড়ে। তারাটি সূর্যের চেয়ে আকারে ৫০ গুণ বড়, ৪ গুণ ভারী, ১৯০০ গুণ উজ্জ্বল এবং সৌরজগৎ থেকে ২০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।
আলমাক (গামা আন্ড্রোমেডা) হল, সপ্তর্ষি তারাপুঞ্জের তৃতীয় উজ্জ্বল হলুদ তারা। আকারে সূর্যের চেয়ে ২.২৬ গুণ বড় এবং সূর্য থেকে ৩৫০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। সপ্তর্ষি নক্ষত্র মন্ডলে অনেক তারা আছে যা’ খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়।
সাত ঋষি ও সাতবোন-পৌরাণিক শাস্ত্র
মহাভারতের মহাকাব্য প্রায় খ্রীঃপুর্ব ৫০০ বছর আগে লেখা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সপ্তর্ষির সাত ঋষির নির্দেশে সূর্য উঠে এবং আলো দেয়। এই ঋষিগণ কীর্তিকা নামক সাত বোনকে বিয়ে করে উত্তর আকাশে বাস করছিলেন। একদিন অগ্নি দেবতা সাত ঋষিদ্বারা প্রদত্ত একটি নৈবদ্য শিখা থেকে হয়ে উত্থিত সাত কীর্তিকাকে ভালবেসে ফেললেন। ব্যর্থ প্রেমে আশাহত অগ্নি বনের ভেতর যখন ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তখন স্রাহার সাথে দেখা হয়। অগ্নির ভালবাসাকে জয় করার জন্য তিনি ছদ্দবেশে ছয় কীর্তিকার রূপ নিলেন। সাত বোনের রূপ নিতে পারলেন না, কারণ সপ্তম বোন আরুনধাতি স্বামীর প্রতি খুব অনুরক্ত ছিলেন। যাহোক, স্রাহার গর্ভে একটি সন্তান হল। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ঋষিগণ তাঁদের স্ত্রীদের তালাক দেন। অরুনধাতি তাঁর স্বামীর সাথে আকাশে তারা (আলকর) হয়ে রইলেন। অন্যান্য কীর্তিকাগণ প্লায়েডিস তারাপুঞ্জ হিসেবে রয়ে গেলে্ন।
গ্রীক পৌরাণিক শাস্ত্রে সাততারাকে অ্যাটলাস (বাবা) ও ওসিয়েনেড প্লিয়েন (মা) সাত কন্যা বলা হয়। কন্যাদের নামঃ মায়া, ইলেক্ট্রা, টইয়েজিটি, সেলায়েন, অ্যালসিওন, স্টেরোপ ও মেরোপ। তাদের প্রত্যেরই দেবতাদের মাধ্যমে সন্তান ছিল, শুধু মেরোপের বিবাহ হয়েছিল সিসিফাসের সাথে। বাইবেলের পুরাতন টেস্টামেন্টে প্লায়েডিস তারাপুঞ্জের নাম তিনবার উল্লেখ আছে। সাততারাকে নিয়ে এমন হাজার হাজার পৌরাণিক কা
আন্ড্রোমেডার পৌরাণিক শাস্ত্র
গ্রীক পৌরাণিক শাস্ত্রে আন্ড্রোমেডা হলেন ইথিওপিয়ার রাজা ক্যাসিওপিয়া (Cassiopeia) ও সিফিয়েস (Cepheus)-এর কন্যা। আন্ড্রোমেডার মাতা দাবি করলেন যে, তাঁরা জল-পরীদের চেয়েও সুন্দরী। জল-কুমারীরা হলেন মৎস্যকন্যা এবং সমুদ্রের দেবী। আন্ড্রোমেডার মায়ের এমন উক্তিতে সমুদ্রের দেবীরা অপমানিত বোধ করলেন এবং তাঁরা সমুদ্র দেবতা পেসাইডনের কাছে প্রতিবাদ করলেন। পেসাইডন সমুদ্র দানব পাঠিয়ে মহাপ্লাবনে ইথিওপিয়ার সম্রাজ্য ধবংস করে দেয়ার হুমকি প্রদান করলেন। দৈববাণীর মাধ্যমে রাজাকে উপদেশ প্রদান করা হল যে, আন্ড্রোমেডাকে বলিদান করতে হবে, তবেই তিনি মুক্তি পাবেন। আন্ড্রোমেডাকে সমুদ্রের দানব দ্বারা গ্রাস করানোর জন্য একটি সমুদ্রের চূড়ায় বেঁধে রেখে দিলেন।
আর্গোস সিটির রাজার ভ্রাতষ্পুত্র পারজিয়েস (Perseus) পাশদিয়ে জাহাজযোগে যাচ্ছিলেন এবং আন্ড্রোমেডাকে দেখামাত্র তাঁর প্রেমে পড়ে যান। পারজিয়েস প্রতিজ্ঞা করলেন যে, তিনি অবশ্যই আন্ড্রোমেডাকে উদ্ধার করবেন যদি তাঁর পিতামাতা আন্ড্রোমেডাকে তাঁর সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়। এ প্রস্তাবে আন্ড্রোমেডার বারা-মা ক্যাসিওপিয়া ও সিফিয়েস রাজি হলেন। এরপর, পারজিয়েস দানবকে হত্যা করলেন এবং আন্ড্রোমেডাকে উদ্ধার করলেন।
আন্ড্রোমেডা তাঁর বাবামাকে খুব পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন যে, তাঁদের বিয়ে যেন খুব জাঁকজমকভাবে উৎযাপন করা হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, আন্ড্রোমেডার বিয়ে নিয়ে পারজিয়েসকে দেয়া প্রতিশ্রুতি তাঁর বাবা-মা সম্পূর্ণ ভুলে গেছেন। যাহোক, আন্ড্রোমেডা পারজিয়েসকেই বিয়ে করেন এবং বিয়ের পর পারজিয়েসের সাথে দেশ ত্যাগ করেন। তাঁরা টিরেন্স (Tiryns) and মাইসিনে (Mycenae) চলে যান। পর্বর্তীতে পারজিয়েস সেখানের রাজা হন। পিতামাতার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করায় পুরস্কার স্বরূপ দেবী আতিনা (Athena) আন্ড্রোমেডার প্রতিচ্ছবি তারাদের মাঝে স্থাপন করেন।
[লেখকঃ সাবেক অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক চেয়ারম্যান পেট্রোবাংলা]