শনিবার, ডিসেম্বর ১৪, ২০২৪
- বিজ্ঞাপন -
হোম মুক্তমত শহর গুলোতে পাখি কমে যাচ্ছে, পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে

শহর গুলোতে পাখি কমে যাচ্ছে, পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে

মোঃ নাজমুল হকঃ পাখি পরিবেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পাখি, আমাদের মনে শান্তির খোরাক যোগায়, ভালোলাগা তৈরি করে। শুধু তাই নয় পাখি পরিবেশে নোংরা বস্তূ এবং বিষাক্ত পোকামাকড় ভক্ষণ করে পরিবেশকে নির্মল রাখে। ফলে আমরা মানুষ এই পরিবেশে ভালো থাকি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি পাখি করে থাকে তা হচ্ছে পাখি পরিবেশে গাছ রোপণ করে এবং পরাগায়ন ঘটায়। পাখি যে কোন জলাশয়ে মাছ চাষ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। অতএব বলা যায় পাখি আমাদের খাদ্য চাহিদা পূরণ সেই সাথে ভিটামিন ও আমীসের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে আবার পরিবেশকেও সবুজ রাখছে। কাজেই আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই পাখিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে তা শহর, গ্রাম বা বনাঞ্চল যেখানেই হোক। পরিবেশে যদি পাখি অনেক পরিমাণে উপস্থিত থাকে তাহলে বুঝতে হবে পরিবেশের অবস্থা ভালো, না হলে মন্দ।

সম্প্রতি বহুল প্রচারিত সংবাদমাধ্যম বিবিসি থেকে প্রকাশিত এক গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের শহর গুলো থেকে পাখি দিন দিন কমে যাচ্ছে। গবেষণার তথ্য মতে পাখি শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে, পরিণত হওয়ার আগেই মৃত্যু ঘটছে এবং তারা শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। শহরে রাতের বেলা অতি উজ্জ্বল আলো, বিশেষ করে এলইডি লাইট এবং যানবাহনের অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক উচ্চ শব্দ এর জন্য দায়ী।

আমরা আমাদের চিন্তা ভাবনায় গবেষণা রিপোর্টটির বিস্তারিত পর্যায় গিয়ে দেখছি যে, সমস্যাটি শুধু যে পাখির জন্য তা নয়, এটা শহরে বসবাসকারী সকল মানুষের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। এমন কি শুধু শহর নয় গ্রামেও একই সমস্যা তৈরি হতে চলেছে এবং একদিন হয়তো শহর ও গ্রাম সমানভাবে এই সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে যাবে। যদিও গ্রামে যানবাহন সমস্যা কম তবে হাইওয়ে গুলো গ্রামের পাশ দিয়েই চলে গেছে। সেই গ্রামে এবং হাইওয়ের দুপাশে গাছপালা রয়েছে। হাইওয়েতে রাত দিন ভারী যানবাহন চলাচল করে। অতএব সেখানে থাকা মানুষ ও পাখি এই সমস্যায় অবশ্যই আক্রান্ত হচ্ছে।

পাখিরা রাতের শুরুতেই ঘুমিয়ে পড়ে এবং ভোরে অন্ধকার থাকতেই উঠে পড়ে এবং তাদের কাজকর্ম শুরু করে দেয়। শহরগুলোতে তাদের একমাত্র আবাসস্থল হচ্ছে শহরের গাছপালা বিশেষ করে বড় বৃক্ষ সমূহ। আমরা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বৃক্ষ কেটে ফেলছি, এর ফলে পাখির আবাসস্থল নষ্ট করা হচ্ছে সাথে সাথে পরিবেশও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পাখিরা দূষিত পরিবেশে থাকতে পারে না আগেই উল্লেখ করা হয়েছে পরিবেশে পাখির উপস্থিতি জানান দেয় পরিবেশ কতটা ভালো। চারপাশে আমরা অবশ্যই লক্ষ্য করবো পূর্বে যত পাখি ছিল, যত প্রকারের পাখি ছিল তত পাখি বা তত প্রকারের পাখি এখন আর নেই।চিরপরিচিত চড়ুই ও কাক এখন অনেক কমে গেছে।

রিপোর্টে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে রাতে শহরে অতি উজ্জ্বল আলো এবং যানবাহনের প্রচন্ড আওয়াজ। মানতেই হবে কারণগুলো যথার্থই সঠিক এবং অবশ্যই আমরা জানি যে গাছপালাও কেটে কমিয়ে ফেলা হয়েছে। এসব কারণে নিশ্চিতভাবে পাখি কমে যাওয়ারই কথা। আমরা এখন খুঁজব সমস্যাটি কোথায় এবং এর কি সমাধান হতে পারে যার দ্বারা পাখিও রক্ষা পায় এবং সাধারন মানুষও শান্তিতে থাকে।

গবেষণায় উজ্জ্বল আলো এবং এলইডি লাইটের কথা বলা হয়েছে অবশ্যই এলইডি লাইট অত্যন্ত উজ্জ্বল আলো তৈরি করে এবং কম বিদ্যুৎ খরচে সহায়ক। আমরা বাড়িঘরে বর্তমানে এই এলইডি লাইট প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করছি। বর্তমানে গ্রাম-গঞ্জ ও মফস্বল এলাকা গুলোতেও বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় সেখানেও প্রচুর এলইডি লাইট ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে কোনো বাঁধা নেই। সমস্যা তখনই যখন এই লাইট ঘরের বাহিরে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা ঘরে ব্যবহারের সাথে সাথে আমাদের ঘরের আঙিনায়, গাছপালায়, সড়কে এবং ঘরের বারতি অংশে ব্যবহার করছি এই এলইডি লাইট বা অন্যান্য উজ্জ্বল আলো। এই আলো সারারাত জ্বলতে থাকে এবং অনেক দূর পর্যন্ত আলো ছড়াতে থাকে। উপরেও ছড়ায় এবং চারিদিকে ছড়িয়ে যায়। ফলে এই লাইটের আশেপাশে থাকা সকল গাছপালায় আলো ছড়িয়ে যায় এবং গাছপালাকে আলোকিত করে ফেলে। যার ফলে গাছে থাকা পাখিরা রাতে ঘুমাতে পারে না, তারা বিরক্ত হয় এবং তাদের প্রজনন ব্যাহত হয়। এ কারণে শহরের গাছপালায় বাস করা তাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে যাচ্ছে। একই কারণে গ্রামেও পাখিরা ভালো নেই। এর সাথে যুক্ত হয়েছে শহরে চলাচল করা যানবাহনের অত্যন্ত অসহ্যকর শব্দ। এই শব্দ হচ্ছে তাদের ইঞ্জিনের শব্দ এবং হর্ণের শব্দ। এই শব্দ মানুষের পক্ষেই সহ্য করা কঠিন সেখানে পাখির কথা তো বাহুল্য। উল্লেখ্য সারারাত জ্বলতে থাকা এই উজ্জ্বল আলো এবং যানবাহনের এই অসহ্য শব্দ পাখির সাথে সাথে মানুষের জীবনও অসম্ভব করে তুলেছে। কারণ এই উজ্জ্বল আলো সাধারণ মানুষের  অন্ধকার ঘরেও পৌঁছে যায় যা তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় এবং তার সাথে যানবাহনের উচ্চ শব্দ তো আছেই। তাই শহরে পাখির সাথে সাথে সাধারণ মানুষও ভালো থাকতে পারছে না। ফলে এর সমাধান উভয়ের জন্যই অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে।

এখন পরিবেশকে ভালো রাখতে হলে পাখিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সেজন্য কয়েকটি শুচিন্তা ও কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা এই ব্যবস্থা অনায়াসে আনতে পারি।
প্রথমতঃ ঘরের বাহিরে বা আঙিনায় লাইট ব্যবহার না করা। যদি একান্তই করতে হয় তাহলে কম উজ্জলের হলুদ লাইট ব্যবহার করা যেতে পারে যার ওপরে অবশ্যই ঢাকা থাকতে হবে, কোনভাবেই সোজাসুজি বা আনুভূমিক বরাবর লাগানো যাবে না। খেয়াল করতে হবে এর আলো যেন কোনো প্রকারেই উপরের দিকে না উঠে এবং চারিদিকে থাকা বাড়িঘর এবং গাছপালায় না ছড়ায়। গাছের গায়ে বা এর ডালপালায় কোন প্রকারেই লাইট ব্যবহার করা উচিত হবে না। এটা সম্পূর্ণ পরিহার করতে হবে। সড়কে সরকারি বা বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক লাগানো লাইটের উপরেও ঢাকা থাকতে হবে। পুরো সাদা আলো ব্যবহার করা যাবে না। যদি সাদা আলো ব্যবহার করাই হয় তাহলে রাত বারোটার পর যেন সাদা আলো বন্ধ করে কম উজ্জল হলুদ আলো জ্বলে সে ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অর্থাৎ পাশাপাশি দুটি লাইটের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হয় কারণ রাত বারোটার পর রাস্তায় অতি উজ্জ্বল আলোর দরকার নেই যেহেতু যানবাহনের চাপ কমে যায়। কিন্তু এখানেও লাইটের ওপরে অবশ্যই ঢাকা থাকতে হবে। ঘর বাড়ির ভিতরে লাইট এমন জায়গায় স্থাপন করতে হবে যেন এর আলো রাতের বেলা বাইরের দিকে ছড়িয়ে না পড়ে। ছড়িয়ে পড়ার অর্থ হচ্ছে আলোক রশ্মি যেন বাইরে না যায়। আলোক রশ্মি ছড়িয়ে পড়লে তা বাহিরের গাছপালা এবং কাছে বা দূরের বাড়িঘরে পৌঁছে যাবে এবং তা পাখি ও সাধারণ মানুষের জন্য কষ্টদায়ক হয়ে যাবে। রাতে চলাচলকারী যানবাহনের হেড লাইটের আলো যেন বেশি উপরের দিকে না ওঠে শুধু রাস্তা বরাবর থাকে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। এই আলো উপরের দিকে ছড়ালে শুধু পাখি নয় বিপরীতমুখী গাড়ির জন্যও সমস্যা। এতে দূর্ঘটনা ঘটতে পারে।

দ্বিতীয়তঃ যানবাহনের উচ্চ শব্দ। রাতে যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত চলাফেরা, যথেচ্ছা শব্দ পাখি, মানুষ তথা কোন প্রাণীর পক্ষেই সহ্য করা অসাধ্য। এই আওয়াজ ইতিমধ্যেই সকল নিয়ম ভঙ্গ করে ফেলেছে এবং কোন আইন দিয়েই এই আওয়াজ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এর জন্য চাই কঠোর ব্যবস্থা। হর্নের আওয়াজ নিয়ন্ত্রণের জন্য অবশ্যই উচ্চশব্দের হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধ করতেই হবে এবং ইঞ্জিনের শব্দ নিয়ন্ত্রণের জন্য সাইলেন্সার (Silencer) ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। অথচ কোনো ভারী যানবাহন সাইলেন্সার ব্যবহার করে না। তারা সাধারণ মানুষের অজ্ঞতাকে পুঁজি করে সাইলেন্সার ছাড়াই যানবাহন চালিয়ে যাচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে সাধারণ মানুষ, শিশু, বৃদ্ধসহ সকলের এবং অবশ্যই পাখির, যে কারণে পাখি শহর ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কাজেই যানবাহনের জন্য দুটি ব্যবস্থা অবশ্যই নিতে হবে একটি হচ্ছে হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধ। এক কথায় উচ্চ শব্দ, তীক্ষ্ণ শব্দ, যেমনি হোক, ছোট বড় যে কোন যানবাহনেই হোক, বন্ধ করতেই হবে এবং ইঞ্জিনে সাইলেন্সার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। কোন প্রকারেই এই সকল আওয়াজ ২০ ডেসিবেলের উপরে উঠতে পারবে না, অথচ বর্তমানে এই হিসাব ৮০ ডেসিবেল যা চিন্তার বাইরে। আরো একটি নিয়ম জরুরী: অযথা আবাসিক এলাকার ভিতর দিয়ে বা আশপাশ দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে। যদি চলাচল করতেই হয় তাহলে নির্দিষ্ট গতিবেগ (সবোর্চ্চ ২০ কি.মি) বেঁধে দিতে হবে যাতে হর্ণের প্রয়োজন না হয় এবং ইঞ্জিনের আওয়াজ নিয়ন্ত্রণে থাকে। এই নিয়ম এই জন্যই দরকার যে আবাসিক এলাকার ভিতরে অনেক গাছপালা থাকে এবং মানুষের পরিবার পরিজনসহ শান্তিপূর্ণ ভাবে বসবাস করার অধিকার রয়েছে। আজকাল কিছু অব্যবস্থার কারনে অনেক আবাসিক এলাকার ভিতর দিয়েই সারা দিনরাত হালকা, ভারী যানবাহন সর্বদাই চলাচল করছে যা অত্যন্ত অসহ্যকর। এটা অবশ্যই বন্ধ হতে হবে। মনে রাখতে হবে এখানে কোমলমতি শিশু, বৃদ্ধ এবং অসুস্থ মানুষরাও থাকে। কোন প্রকারেই তাদেরকে অন্তত কষ্ট দেওয়া চলবে না।

অতএব সমাধান পাওয়া গেল যে উপরোক্ত দুটি ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আমরা শহরে থাকা পাখিদের রক্ষা করতে পারবো। পাখি রক্ষা করা মানে পাখির প্রজাতি রক্ষা। আর প্রজাতি রক্ষা করার অর্থ জীববৈচিত্র্য রক্ষা। এই রক্ষার মাধ্যমে জলবায়ু রক্ষার কাজও এগিয়ে যাবে। ফলে আমাদের পরিবেশ-প্রকৃতি ভালো থাকবে সেই সাথে আমরাও ভালো থাকবো। আমাদের শিশুরা একটা শান্তিময় নির্মল পরিবেশে বেড়ে উঠবে।

**মতামতের জন্য সম্পাদক / প্রকাশক দায়ী নয়

1 মন্তব্য

আপনার মতামত দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

Most Popular

সিরাতুন্নবী (সা.) মানবজাতির জন্য একটি বিশ্বজনীন বার্তাঃ ধর্ম উপদেষ্টা

ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেছেন, ‘সিরাতুন্নবী (সা.) মানবজাতির জন্য একটি বিশ্বজনীন বার্তা। রাসুল (সা.) এর জীবনাদর্শ কেবল মুসলমানদের...

শহিদ বুদ্ধিজীবীগণ দেশের ক্ষণজন্মা শ্রেষ্ঠ সন্তানঃ তারেক রহমান

বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শহিদ বুদ্ধিজীবীদের দেশের ক্ষণজন্মা শ্রেষ্ঠ সন্তান উল্লেখ করে বলেছেন, একটি সমৃদ্ধ এবং মাথা উঁচু করা জাতি দেখতে...

শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস আগামীকাল

আগামীকাল ১৪ ডিসেম্বর, শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসরা বাংলার শ্রেষ্ঠ...

নওগাঁয় ৭ হাজার ৬৩৫ হেক্টর জমিতে ভূট্টা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ 

চলতি রবি ২০২৪-২৫ মৌসুমে নওগাঁয় ৭৬৩৫ সেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।  কৃষি বিভাগের তথ্য মোতাবেক গত বুধবার পর্যন্ত জেলায়...

Recent Comments