বুধবার, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৪
- বিজ্ঞাপন -
হোম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণ গহবর

ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণ গহবর

অধ্যাপক ড. হোসেন মনসুর

আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব উদ্ভাবনের মাধ্যমে আইনস্টাইন খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর এ তত্ত্বের মাধ্যমে স্থান, কাল, মাধ্যাকর্ষণ এবং মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের বোধগম্যতার এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। আপেক্ষিকতা প্রমাণ করে যে, বস্তু এবং শক্তি তাদের আকার বা গঠন দুই রকম হলেও বাস্তবে তারা একই জিনিষ। আর তা’ প্রমাণ করেছেন একটি সূত্রের মাধ্যমে, সূত্রটি হল, আলোর গতির বর্গকে ভর দিয়ে গুণন করলে যে গুণফল পাওয়া যায় তা’হল শক্তি (E=mc2।)। আবার আইনস্টাইনই সর্বপ্রথম ১৯১৬ সালে মহাবিশ্বে ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্বের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, যা’ বহুবছর পরে ১৯৬৭ সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী জন হুইলার দেখতে পেয়েছিলেন। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বে উল্লেখ আছে যে, একটি শক্তিশালি মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র থেকে বিচ্ছুরিত রশ্মির ভ্রমন পথে শক্তি কমে যায় এবং তরঙ্গ দৈর্ঘ প্রসারিত হতে থাকে। প্রসারিত হতে হতে ক্রমেই লাল রঙের তরঙ্গ দৈর্ঘে রুপান্তরিত হয়, যাকে মহাকর্ষীয় লোহিত সরণ (Gravitational Redshift) বলে। আইনস্টাইনের এমন পূর্বাভাস প্রায় একশত বছর পরে ২০১৮ সালে গ্রাভিটি কলাবোরেশন এস-০২ (Gravity Collaboration, S-02) তারার ক্ষেত্রে প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন।

ওই তারাটি আমাদের গ্যালাক্সি ছায়াপথের কেন্দ্রে অবস্থিত ব্ল্যাকহোলকে প্রদক্ষিণ করে। ওই টিম হাওয়াইতে কেক (Keck Telescope) টেলিস্কোপসহ আরোও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ২৪ বছর ধরে এস-০২ তারার অবস্থান ও গতিবেগ পর্যবেক্ষণ করেন। প্রাপ্ত সকল তথ্য-উপাত্ত সূক্ষভাবে বিশ্লেষণ করে দেখতে পান যে, তারাটি ১৬ বছর ধরে ব্ল্যাকহোলকে প্রুদক্ষিন করছে। তারপর ২০১৮ সালে তাঁরা তাঁদের পর্যবেক্ষণকৃত উপাত্তসমূহ সমম্বয় করে ব্ল্যাকহোলের নিকটতম পদ্ধতি অনুসরণ করে দেখতে পান যে, লোহিত সরণ (Redshift) সম্পর্কে আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্বে যে পূর্বভাস দিয়েছিলেন তার সাথে মিলে যায়। আইনস্টাইনের এই তত্ত্ব প্রমাণ করতে একশত বছর লেগে গেল। ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণ গহবর স্থান-কালের (spacetime) এমন একটি এলাকা যেখানে মাধ্যাকর্ষণ ধারণাতীতভাবে বেশি। এত বেশি যে সেখান থেকে কিছুই রক্ষা পায় না। এমনকি, তড়িচ্চুম্বকিয় বিকিরণ, যেমন, আলোও রেহাই পায় না। মানে, সবকিছুই ওর ভিতরে ঢুকে পড়ে। ওই স্থানের উপর দিয়ে কিছুই আসতে পারে না। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার সূত্র অনুযায়ী ধারণা করা যায় যে, অত্যন্ত ঘন পদার্থ স্থান-কালকে বিকৃত করে ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণ গহবর তৈরী করেছে। ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণ গহবর স্থানসময়কে (space time) সিঙ্গুলারিটির (Singularity) দিকে নিয়ে যায়। যখন কোন বিশাল তারার মৃত্যু হয়, তখন ওই তারার অবশিষ্ট খুব ঘন কোর নিয়ে ব্ল্যাকহোল গঠন করে। সোজা কথায়, ব্ল্যাকহোল হল, মহাশূন্যের এমন একটি স্থান যেখানের মাধ্যাকর্ষণএর আকর্ষণ শক্তির টান এত বেশি যে আলোর কণা পর্যন্ত সেখান থেকে বের হতে পারে না। এর কারণ হল, সেখানের সকল বস্তু চিপা হয়ে ক্ষুদ্রাকারে থাকে। ফলে মাধ্যাকর্ষণ কল্পনাতীতভাবে বেশি। যেহেতু আলো ওখান থেকে বের হতে পারে না, তাই জায়গাটি চোখে দেখা যায় না, কাল দেখায়। চোখে দেখা না গেলেও, বিশেষ যন্ত্রপাতির মাধ্যমে ব্ল্যাকহোলের অবস্থান জানা যায়। বিশেষ যন্ত্রপাতির মাধ্যমে এও দেখা যায় যে, ব্ল্যাকহোলের নিকটবর্তী তারাগুলো অন্যান্য তারা থেকে কেমন যেন বিরূপ আচরণ করছে। হকিংস রেডিয়েশন একটি ব্ল্যাকবডি হল, একটি আদর্শিক কাল বস্তু (শারীরিক শরীর) যা’ আপতিত সকল বৈদ্যুতিন চৌম্বকীয় বিকিরণ শোষণ করে, আর তা’ যে কোন ফ্রিকোয়েন্সির হোক বা আপতন কোণ যাই হোক না কেন।

ব্ল্যাকবডি নাম দেয়া হয়েছে এ কারণে যে, ব্ল্যাকবডি সকল ফ্রিকোয়েন্সির বিকিরণ শোষণ করে। শুধু তাই না, একটি ব্ল্যাকবডি কালবডি বিকিরণও করতে পারে। হকিংস রেডিয়েশন হল, ব্ল্যাকহোলের নিকটবর্তী ইভেন্ট হরিজনে কোয়ান্টামের প্রভাবে কালবডি বিকিরণ হয় যা ব্ল্যাকহোল দ্বারাই মুক্ত হয় বলে অনুমান করা হয়। স্টিফেন হকিংসের নামানুসারে হকিংস রেডিয়েশন নামকরণ করা হয়েছে। বলে রাখা প্রয়োজন, ইভেন্ট হরিজন হল, ব্ল্যাকহলের চারপাশে এমন একটি সীমানার স্থান যেখান থেকে কোনকিছুই, এমনকি আলোও বের হতে পারে না। কৃষ্ণ গহবরের অন্তর্ধান হকিংস রেডিয়েশন ব্ল্যাকহলের ভর ও ঘূর্ণন শক্তিকে কমিয়ে ফেলে। একে ব্ল্যাকহোল বাষ্পীভবন বলে। কেননা, ব্ল্যাহকহোল অন্য কোথাও থেকে ভর সংগ্রহ করতে পারে না। তাই ধারণা করা যায়, ভর ও শক্তি কমতে কমতে কোন এক সময়ে নিঃশেষ বা উধাও হয়ে যাবে। হকিংস রেডিয়েশন অনুযায়ী যখন কোন কণা বের হয়ে আসে তখন ব্ল্যাকহোল কিছুটা হলেও শক্তি বা ভর হারায় (Einstein’s equation E = mc2)। তাই বলা যায়, বাষ্পীভূত ব্ল্যাকহোলের জীবনের সীমাবদ্ধতা আছে। ডাইমেনশনাল অ্যানালাইসিসে (dimensional analysis) দেখানো হয়েছে, ব্ল্যাকহোলের জীবনকাল তার প্রাথমিক ভরের বর্গের সমান। স্টিফেন হকিংস অনুমান করেছেন যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রথমদিকে ১০১৫ গ্রামের চেয়ে কম ভর সম্পন্ন যেসব ব্ল্যাকহোল গঠন করেছে, সেগুলো বর্তমানে পুরাপুরিই বাষ্পীভূত বা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অর্থাৎ, বর্তমানে তাদের কোন অস্তিত্ব নেই। ব্ল্যাকহোল কত বড়? অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, কোন কোন ব্ল্যাকহোল এত ছোট যে, তার আকার একটি পরমানুর আকারের মত। কিন্তু তাদের ভর একটি বিশাল পর্বতের সমান। অন্য ধরণের ব্ল্যাকহোল আছে তাদের নাক্ষত্রিয় ব্ল্যাকহোল বলে। সেগুলোর ভর প্রায় সূর্যের ভরের চেয়ে ২০ গুণেরও বেশি। আমাদের ছায়াপথে অনেক বড় বড় নাক্ষত্রিয় ব্ল্যাকহোল আছে। সবচেয়ে বিশাল ব্ল্যাকহোলকে অসীম ভরের ব্ল্যাকহোল বা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল (supermassive) বলে। সেসকল ব্ল্যাকহোলের ভর সূর্যের ভরের চেয়ে দশ লক্ষ গুণেরও বেশি। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন যে, প্রত্যেক বিশাল গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটি করে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল আছে। আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল আছে যার নাম স্যাজিটারিয়াস। এর ভরের পরিমান ৪০ লক্ষ সূর্যের ভরের সমান।

বিশ্বব্রম্মান্ড সৃষ্টির সময়েই ছোট ছোট ব্ল্যাকহোল গঠিত হয়েছে। আর সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল গঠিত তখন যখন কোন বিশাল তারার কেন্দ্র ধসে যায় (collapses)। আর এমন যদি ঘটে তবে সপারনোভা বিস্ফোরণ হয়। খন্ডিত বিচ্ছিন্ন কোর (অংশ) ব্ল্যাকহোল গঠন করে। গ্যালাক্সি গঠনের সময়ই সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল গঠিত হয়েছে। হকিং বিকিরণ (রেডিয়েশন) ব্ল্যাকহোলের ভর ও ঘূর্ণন শক্তিকে মন্থর করে দেয়। আর এ কারণে, ব্ল্যাকহোল অন্য কোথাও থেকে ভর সঞ্চয় করতে পারে না। ধারণা করা যায় যে, ব্ল্যাকহোল সঙ্কুচিত হতে হতে শেষমেষ উধাও হয়ে যাবে। অনেকেই প্রুশ্ন করেন, ব্ল্যাকহোলে কি সময় শূন্য বা বন্ধ হয়ে যাবে? আমরা যতটুকু জানি তা’হল, কোন বস্তু বা আলোকরশ্মি যদি আলোর গতিতে চলে, তবে তার সময় শূন্য হয়ে যায়। কারণ, সময় হল, কোন বস্তু বা আলোকরশ্মি কতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করলো তার মাপকাঠি। তাই, কোন বস্তু (বা আলোকরশ্মি) যদি আলোর গতি পায়, তা’হলে সময় সম্ভবতঃ শূন্য হয়ে যাবে। ব্ল্যাকহোল আমাদের পৃথিবী, গ্রহ-উপগ্রহ বা সৌরজগৎ কোন কিছুকেই গ্রাস করবে না। কারণ, আমাদের সৌরজগতের কাছাকাছি কোন ব্ল্যাকহোল নেই। সূর্যের ভরের সমান ভরের কোন ব্ল্যাকহোল যদি সূর্যের অবস্থানে থাকত, তবুও পৃথিবী বা সৌরজগতের কোন প্রভাব পড়তো না। গ্রহ-উপগ্রহ একই রকমভাবে নিজ নিজ কক্ষে প্রদক্ষিন করতে থাকত। আর সূর্য কোনদিনও ব্ল্যাকহোল তৈরী করতে পারবে না, কারণ সূর্যের ব্ল্যাকহোল তৈরী করার মত তত ভর নেই। (সৌজন্য-ফ্লিন্ট ওয়াইড, নাসা)।

লেখকঃ সাবেক অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক চেয়ারম্যান পেট্রোবাংলা।

আপনার মতামত দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

Most Popular

১৪ সেপ্টেম্বর ছাত্র-অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণ সভাঃ সালেহউদ্দিন

সাম্প্রতিক বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের শহিদদের অবদান স্মরণে সরকার ১৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে একটি স্মরণ সভা করতে যাচ্ছে।আজ সচিবালয়ে অর্থ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে...

কাজে দীর্ঘসূত্রতা পরিহার এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে-পার্বত্য উপদেষ্টা

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বলেছেন, জুম চাষে আগুন লাগলে যেমন এর আশেপাশের সবকিছুই পুড়ে ছাড়খার হয়ে যায়- ঠিক তেমনি...

অক্টোবর থেকে সুপারশপে পলিথিন ও পলিপ্রপিলিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধঃ পরিবেশ উপদেষ্টা

আগামী ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে কোনো পলিথিন শপিং ব্যাগ ও পলিপ্রপিলিনের ব্যাগ রাখা যাবে না বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের পরিবেশ, বন ও...

বৈষম্যমুক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম গড়তে কাউকে পিছিয়ে রাখা হবে নাঃ পার্বত্য উপদেষ্টা

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বলেছেন, সবাইকে আইন-শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, বৈষম্যমুক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম গড়তে...

Recent Comments