শনিবার, জানুয়ারি ১৮, ২০২৫
- বিজ্ঞাপন -

নীহারিকা (Nebula)

অধ্যাপক ড. হোসেন মনসুর

নেবুলা (Nebula) শব্দটি ল্যাটিন থেকে এসেছ। ল্যাটিন ভাষায় নেবুলার অর্থ, কুয়াসা, ধোঁয়া, জলীয়বাষ্প, বাষ্পনির্গমন। বাংলায় নেবুলাকে নীহারিকা বলা হয়। মহাশূন্যে ধূলিকণা ও গ্যাস দ্বারা নীহারিকা গঠন করে। কোন কোন নীহারিকা মহাশূন্যে বিস্ফোরের কারণে ছিটকে যাওয়া ধূলিকণা ও গ্যাস দ্বারা নীহারিকা গঠন করে, যেমন, সুপারনোভার পরে একটি তারার যখন মৃত্যু হয় তখন ওই তারার ধূলিকণা ও গ্যাস দ্বারা নীহারিকা গঠন করে। আবার কোন কোন নীহারিকা নূতন তারা গঠনের স্থানেও দেখা যায়। সে জন্য নীহারিকাগুলোকে তারা উৎপাদনের নার্সারি বলা হয়। নীহারিকার মধ্যে যথেষ্ট পরিমানে ধূলিকণা ও গ্যাস থাকে। ওই ধূলিকণা ও গ্যাস মাধ্যাকর্ষণের কারণে জমা হতে থাকে। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে ধীরে ধীরে জমাট খণ্ডের কেন্দ্রে চাপ এবং সেই সাথে তাপমাত্রাও বাড়তে থাকে। তখন তাকে প্রোটোস্টার বলে। কেন্দ্রে তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে যখন এক কোটি কেলভিন হয়, তখন চাপ এত বৃদ্ধি পায় যে সেখানে হাইড্রোজেন গ্যাসের নিউক্লিয়ার ফিউশন শুরু হয়। নক্ষত্র পারমানবিক চুল্লিতে রূপান্তরিত হয়। এভাবেই তারার জন্ম হয়। নক্ষত্র গঠনের বিশয়টি আমরা আগেই আলোচনা করেছি। আমাদের গ্যালাক্সি ছায়াপথে গোলাকার, উপবৃত্তাকার ও দ্বিমেরু বিশিষ্ট প্রায় ৩০০০ অস্থিরমতি নীহারিকা আছে এবং প্রায় সবগুলোই ছায়াপথ গ্যালাক্সির কেন্দ্রের কাছাকাছি অবস্থিত।কালপুরুষ (Orion)

‘মহাকাল কথা কও’ শিরোনামে আমাদের এক সহকর্মী সৈয়দ মাঝারুল হক একটি বই লিখেছিলেন। মহাকাল কিন্তু কথা বলেনি। তিনি নিজেই সাত আসমান পাড়ি দিয়ে তারার দেশে চলে গিয়েছেন। কত রহস্য লুকিয়ে আছে তারার দেশে! দূর থেকে তারারা সবই দেখে, মহাকালের সাক্ষী, কিন্তু সাক্ষ্য দেয় না। মানুষের আবেগ-অনুভূতি, চাওয়া-পাওয়া, ক্ষোভ বা না পাওয়ার রিক্ত বেদনা সবই শূন্যে মিলিয়ে যায় তারার দূর দেশে! কালপুরুষের দেশে, যে দেশে কোনদিনও যাওয়া সম্ভব নয়। সাত তারা আর কালপুরুষকে কে না দেখেছে। প্রাইমারি বৃত্তির প্রথম টাকা দিয়ে একটি অলসন টেবিল ঘড়ি কিনেছিলাম। লক্ষ্য ছিল, আমি কত রাত জেগে পড়বো, তা’ বলে দিবে। প্রথমে ঘড়িটি অশ্ব গতিতে চলতে লাগলো। পেছনের কাঁটা দিয়ে গতি ঠিক করতে যেয়ে পাওয়া গেল কচ্ছব গতি। ঘন্টায় প্রায় ৩/৫ মিনিট লেট। ঘড়ির উপর আমার আস্থা উঠে গেল। আমার একমাত্র ভরসাস্থল হল কালপুরুষ। যে আমাকে ফাঁকি দেয়নি। সময়ের সাথে সাথে কালপুরুষও আকাশে স্থান পরিবর্তন করতে থাকে। ঘড়ি আমাকে একটি উপকার করেছিল, তা’হল, কোন মাসে কোন সময়ে কালপুরুষ আকাশে কোথায় অবস্থান করবে। একেবারে সঠিক না হলেও সঠিরের কাছাকাছি তো বটে!

তা’হলে দেখি কে সেই মহান কালপুরুষ। কালপুরুষের আসল নাম ‘ওরিওন’। ওরিওন একটি উল্লেখযোগ্য সুস্পষ্ট ও দেদীপ্যমান উজ্জ্বল নক্ষত্রপুঞ্জ যা’ পৃথিবীর সকল স্থান থেকেই রাতের পরিস্কার আকাশে দেখা যায়। প্রাচীন গ্রীসের একজন শিকারীর নাম অনুসারে তার নামকরণ করা হয়েছে ‘ওরিওন’। আমাদের বাংলা ভাষায় কালপুরুষ ওরিওনে সবচেয়ে উজ্জ্বল দু’টি তারাঃ একটি নীল তারা, নাম রিগেল (বাংলায় পা) এবং অন্যটি লাল, তার নাম লাল সুপারি, ইংরেজিতে লাল বেটেলজাজ (red Betelgeuse) বলে। রিগেল কাল্পনিক কালপুরুষের (শিকারীর) বাম পা। গ্রীসের পৌরাণিক কথায় আছে, ওরিওন (কালপুরুষ) একজন প্রতিভাবান শিকারী ছিলেন। তিনি গর্ব করে বলেছিলেন যে, তিনি পৃথিবীর সমস্ত হিংস্র প্রাণীদের হত্যা করে পৃথিবীকে হিংস্র প্রাণী মুক্ত করতে পারেন। তাঁর এমন দম্ভে দেবী গায়া ভীষণ রেগে যান। কারণ, দেবী গায়া হলেন পৃথিবীর সকল প্রাণীর রক্ষাকর্তা। তাঁকে পরাস্ত করতে দেবী গায়া স্কর্পিওন (বৃশ্চিক-বিচ্ছু বা কাঁকড়াবিছা) প্রেরণ করেন। স্কর্পিওন তার তীক্ষ্ণ বিষাক্ত হুল দ্বারা ওরিওনকে প্রচন্ডভাবে আঘাত করে এবং পরাস্ত করে। তাই, দেবী গায়া বৃশ্চিকের ছবি আকাশে স্থাপন করেন যেন তিনি সকল সময় স্কর্পিওনকে দেখতে পান। ওরিওনকে স্কর্পিওন তাড়া করছে এমন দৃশ্যই আকাশে দেখা যায়। মহাজাতি (procyon) দু’টি কুকুরকে (canis major and canis minor) পেছনে নিয়ে, শশক (Lepus) ও খরগোশকে (Hare) তাড়া করছে। অনেকেই মনে করেন, ১০০০০ বছর পূর্বে নির্মিত মিশরের প্রধান তিনটি পিরামিড কালপুরুষের তিনটি তারার সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে নির্মাণ করা হয়েছে। বৃশ্চিকের অবস্থানে সূর্য থাকার সময় যদি কেউ জন্মগ্রহণ করে তখন জ্যোতিষীরা তাকে বৃশ্চিক রাশির শিশু বলে। আন্তর্জাতিক জ্যোতিষবিজ্ঞানীদের ইউনিয়ন কতৃক স্বীকৃত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি তারার নামঃ অ্যালিলাম, আলনিটাক, বেল্ল্যাট্রকস, বেটেলজাজ, হাতিসা, মিসা, মনটাকা, রিগেল, সাইফ ও তাবিট।

পৌরাণিক কাহিনী কালপুরুষকে নিয়ে মানুষের উৎসুক্যের শেষ নেই। কালপুরুষ লেখক, কবি, শিল্পীদের মনে যে দোলা দেয় তার অনুভূতি ফুটে ঊঠে ভাষায়, ছন্দে ও চিত্রে। এমন আলোড়িত মনের ব্যাকুল প্রবাহ চলছে যুগ-যুগান্তর, কাল-কালান্তর। ১৯৭৯ সালে পশ্চিম জার্মানির আর্চ উপত্যকার একটি গুহায় ৩২,০০০ থেকে ৩৮,০০০ হাজার বছর পুরাতন একটি আইভরি পাওয়া গেছে। তাতে খোদাই করে কালপুরুষের প্রতিচ্ছবি অঙ্কিত আছে। অ্যাসিরিয়ান, সুমেরিয়ান, ব্যাবিলিয়ান, মিশরীয় বা গ্রিক সভ্যতা বিকাশের এত আগে কালপুরুষ যে মানুষের মনে দাগ কেটে যেত, ওই আইভরিই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

ব্যাবিলন সভ্যতার (ব্রোঞ্জ যুগ) তারার ক্যাটালগে কালপুরুষ বা ওরিওনকে স্বর্গীয় রাখাল বা আনুর সত্য রাখাল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সে সময়ে আনুকে স্বর্গরাজ্যের প্রধান দেবতা মনে করা হত। ব্যাবিলনীয় তারাপুঞ্জ পাপশুকাল এবং নিনশুবুরের কাছে পবিত্র। পাপশুকাল এবং নিনশুবুর উভয়ই ছোট দেবতা এবং তাঁরা বড় দেবতাদের ইচ্ছে পূরণের জন্য বাহক হিসেবে কাজ করতেন। তাঁরা মানুষের পক্ষে দেবতাদের সুপারিশ ও প্রার্থনা করতেন। ব্যাবিলনের প্রাচীরে একটি পাখির হেঁটে যাওয়ার চিত্র আছে। ওই চিত্রটির সাথে পাপশুকালের সম্পৃক্ততা আছে। তারার মানচিত্রে পাখির (মোরগের) চিত্র সত্য রাখালের (কালপুরুষের) নীচে এবং পেছনে দেখা যায়। তাই, ওই দু’টি তারাপুঞ্জ পাখি এবং মানুষের আকৃতিতে দেবতাদের আগমন বার্তা বুঝায়।

প্রাচীন মিশরে কালপুরুষ তারাপুঞ্জকে দেবতা হিসেবে গন্য করা হত। কালপুরুষকে তারা ‘শাহ’ বলে অভিহিত করতো। ওরিওন তারাপুঞ্জে সিরিয়াস একটি উজ্জ্বল তারা। সেকালের মিশরীয় ক্যালেন্ডারের ভিত্তিই ছিল সিরিয়াস। ওরিওন সিরিয়াসের আগে উদয় হয়। শাহ-এর (কালপুরুষের) সাথে দেবী ‘সপডেট’এর একটা গভীর সম্পর্ক ছিল। দেবী সপডেট সিরিয়াসের মাধ্যমে ব্যক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন। শাহ ও সপডেটের পুত্র হলেন দেবতা সপডু। অর্থাৎ, কালপুরুষ ও সিরিয়াসের পুত্র দেবতা সপডু। বাইবেলে ওরিওনের নাম তিনবার উল্লেখ করা হয়েছ। বাইবেলে ওরিওনকে ‘কেসিল’ বলা হয়েছ। কেসিলের অর্থ হল, বোকা। প্রাচীন আকাডিয়ান সভ্যতায় ওরিওনকে ‘নিফিলা’ বলা হত। ওরিওন তারাপুঞ্জ সারিবদ্ধ তিন রাজা বা তিন বোন বলা হয়। তারাগুলোর নামঃ অ্যালনিট্যাক, অ্যালনিনাম ও মনতাকা। মহাভারতে ওরিওনকে যোদ্ধা স্কান্দা নাম করণ করা হয়েছ। স্কান্দা হলেন ছয় মাথা বিশিষ্ট শিবপুত্র।ওরিওন গ্যালাক্সির গুরুত্বপূর্ণ উজ্জ্বল তারাগুলো পৃথিবী থেকে দূরে তা’ নিম্নে টেবিল আকারে দেয়া হলোঃতারার নামপৃথিবী থেকে দূরত্ব(আলোক বর্ষ)তারার নামপৃথিবী থেকে দূরত্ব(আলোক বর্ষ)বেটেলজাজ৬২৪রিগেল৭৭২বেল্লাট্রিকস্‌২৪৫মিনটাকা৯১৬অ্যালনিলাম১,৩৪২অ্যালনিট্যাক৮০০সাইফ৬৫০মেইসা১,০৪২ ওরিওন নিয়ে কালাকাল ধরে যেসব পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে তার সামান্য অংশও একটা মানুষের পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। তাই, পৌরাণিক রসালো গল্প, কার্টুন এবং শিল্পীর আঁকা ছবির বিষ্যটি এখানেই শেষ করলাম।

আপনার মতামত দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

Most Popular

লালমনিরহাটে আলু-পেঁয়াজ-সবজির বাজারে স্বস্তি

জেলার বাজারগুলোতে শীতকালীন সবজি, আলু ও পেঁয়াজের দামে স্বস্তি ফিরেছে। সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব পণ্যের কেজি প্রতি দাম কমেছে ২০ টাকা থেকে...

তরুণদের সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশের চিত্র পাল্টে যাবেঃ বিএনপি মহাসচিব 

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তরুণ প্রজন্ম আধুনিক প্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত। তাদের মেধা শক্তি অনেক ভালো। তরুণদের...

সোমবার ট্রাম্পের জাঁকজমকপূর্ণ প্রত্যাবর্তন

ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী সোমবার দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। ৭৮ বছর বয়সী এই রিপাবলিকান নেতা ওয়াশিংটনের ইউএস ক্যাপিটলে...

কৃষিতে নারীশ্রম, ফসলে চওড়া হাসি

অগ্রহায়ণ শেষে পৌষের আগমন। প্রকৃতিতে ইতোমধ্যে শীতের দাপট। আমন ধান কাটা ও মাড়াইয়ের মৌসুম শেষ। এখন চলছে নানা ধরনের শাক-সবজি আর শস্য...

Recent Comments