অধ্যাপক ড.হোসেন মনসুর
আমরা চলনবিলের মানুষ। আমার গ্রামটি নিভৃত পল্লী চলনবিলের প্রাণকেন্দ্রে। আষার-শ্রাবনে ভরা মৌসুমে অথৈ জলে বিল উত্তাল হয়ে উঠতো। শাঁ শাঁ শব্দ করে বাতাস আর মাতাল ঢেউগুলো ঠাস ঠাস করে আছড়ে পড়তো উঠানের পাতগোড়ায়। বৃষ্টি আর কাদা, উঠেনে লম্বা ধাপ দিয়ে দিয়ে রাবারে প্যাঁচানো খড়ম পায়ে যেতে হত বৈঠকখানায়। মুশলধারে বৃষ্টির শব্দছাড়া ওই ঋতুর আর কিছুই আমার ভাল লাগতো না। এর পরে আসতো শরৎকাল। জলে স্ফীত শান্ত চলনবিল। বিলের দিকে তাকালে মনে হত আমরা দ্বীপের বাসিন্দা। দ্বীপ কাহাকে বলে আর মুখস্ত করতে হত না। পার্থক্য শুধু পানিতে, আমাদের গ্রাম রূপান্তর হত বহমান সাদা পানি বেষ্টিতঅপূর্ব দ্বীপে। জ্যোস্নারাতে পুবের আকাশের চাঁদের আলোর প্রতিফলন পানিতে ঝিলিক মারতো। উঠানে মাদুর পেতে গান-বাজনা, রাজা-বাদশা অথবা রাজকুমার-রাজকন্যার গল্প। মনে হয়, এই তো মাত্র সেদিনের কথা! অথচ ইতোমধেই ষাট বছর পাড় হয়ে গেছে। তখন গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। পূর্বে ৪০ মাইল দূরে সিরাজগঞ্জ ও পশ্চিমে ৪০ মাইল দূরে নাটোর শহরে বিদ্যুৎ ছিল। আমরা অন্ধকারেই ছিলাম। অমাবাস্যার রাতে ঘুটঘুটে গভীর অন্ধকার। মেঘশূন্য আকাশ ছিল তারায় তারায় ঝলমল। সেই তারা ভরা আকাশ এখন আর দৃশ্যমান নেই। গ্রামে-গঞ্জে বিদ্যুৎ। বিদ্যুতের আলোর তরঙ্গ তারা হ’তে আগত আলোর তরঙ্গকে ম্লান করে দেয়। ছোট তারার আলো চোখেই পড়ে না। তাই ছায়াপথের তারার ঝাঁক আর ওতো ঝলমল করে না। এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের আলো বিহীন পাহাড়ের চূড়ায় হয়তো তেমন আকাশ দেখা যেতে পারে। কেন যে বাংলার জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ছায়াপথ নাম দিয়েছেন জানিনা। পথটি তো ছায়ার নয়, ওটা আলোর মহাসড়ক।
অমাবাস্যার রাতের গভীর অন্ধকারে কুয়াসা ও মেঘশূন্য আকাশের দিকে তাকালে যত নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ, আস্টেরইড, উল্কা, ধুমকেতুসহ খালিচোখে আমরা যা’ কিছুই দেখি না কেন সবকিছুই অবস্থান করে একটি গ্যালাক্সিতে। সে গ্যালাক্সি আমাদের ছায়াপথ। আগেই বলা হয়েছে কোটি কোটি নক্ষত্র, বিভিন্ন প্রকার গ্যাস ও ধূলিকণা নিয়ে বিশাল আকারের এক-একটি গ্যালাক্সি তৈরী হয়। মহাশূন্যে ঘূর্ণীয়মান গ্যালাক্সির চাকতি ভাসে হাজার কোটি ঘুড়ির মত। বর্তমান হাবল টেলিস্কোপ দিয়ে প্রায় ১০০ বিলিয়ন (১০০ কোটি = ১ বিলিয়ন) গ্যালাক্সির সন্ধান পাওয়া যায়। টেলিস্কোপ টেক্নোলজি উন্নত হলে ২০০ বিলিয়ন বা তারও বেশি গ্যালাক্সি পাওয়া যাবে বলে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন। মাধ্যাকর্ষেণের টানে এগুলো একসঙ্গে আবদ্ধ থাকে। এক-একটি গ্যালাক্সির আকার ও আকৃতি এক এক রকম। সূর্য এবং সূর্যের চারদিকে ঘূর্ণায়মান সকল বস্তু, যেমন, গ্রহ, উপগ্রহ, উল্কাপিণ্ড ইত্যাদিকে বলা হয় সৌরজগৎ। সৌরজগতসহ আমরা যে গ্যালাক্সিতে অবস্থান করছি ইংরেজীতে তার নাম দেয়া হয়েছে মিল্কিওয়ে, আমরা যাকে বলি ছায়াপথ, আবার কেউ কেউ বলেন, আকাশগঙ্গা। আমাদের সৌরজগৎ ছায়া পথের অতি ক্ষুদ্র একটা অংশ। পুঞ্জ পুঞ্জ তারার সমারোহে আকাশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত প্রসারিত এক উজ্জ্বল মহাসড়ক।
ছায়াপথে অনেক তরুণ বা অল্পবয়সী উজ্জ্বল নক্ষত্র ও হাইড্রোজেন আয়নযুক্ত মেঘ দেখা যায়। অল্পবয়সী নক্ষত্র দ্বারা আয়নযুক্ত ওই মেঘ সৃষ্টি হয়েছে এবং মূলতঃ সেখানে মুক্ত (free) প্রোটন ও ইলেক্ট্রন আছে। এরকম আয়নযুক্ত উজ্জ্বল নক্ষত্রের স্থানগুলোই স্পাইরাল বা শার্পিল গ্যালাক্সির বৈশিষ্ট। অবশ্য গভীর অন্ধকারে খালি চোখে উত্তর গোলার্ধে একটি ও দক্ষিণ গোলার্ধে দু’টি গ্যালাক্সি দেখা যাবে। উত্তর গোলার্ধের ছায়াপথের ছোট্ট ওই স্থানটুকু একটু আলোকিত, মনে হবে দু’টি তারা জোড় বেঁধে আছে। অনেকেই তারা দু’টিকে জমজ বোন বলেন। আসলে তারা দু’টি জমজ বোন নয়। ওরা আমাদের গ্যালাক্সির নিকটতম আর একটি গ্যালাক্সির দু’টি উজ্বল অংশ। ওই গ্যালাক্সির নাম অ্যান্ড্রোমেডা। অ্যান্ড্রোমেডা একটি বড় গ্যালাক্সি। অ্যান্ড্রোমেডা আমাদের ছায়াপথ থেকে ২.৫ মিলিয়ন (২৫ লক্ষ; ১ মিলিয়ন = ১০ লক্ষ) আলোকবর্ষ দূরে । দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে দৃশ্যমান গ্যালাক্সি দু’টোকে স্যাটেলাইট গ্যালাক্সি বলে, প্রায় ১৬০,০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। মনে করিয়ে দেই ছোট্ট বিষয়, আলো প্রতি সেকেন্ড ১৮৬০০০ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে। সে হিসেবে এক বছরে যে দূরত্ব অতিক্রম করে সেই দূরত্বকে এক আলোকবর্ষ বলে। ছায়াপথ একটি স্পাইরাল গ্যালাক্সি (spiral Galaxy) বা শার্পিল গ্যালাক্সি। এখন অনেকেই এই গ্যালাক্সিকে বাড শার্পিল (barred spiral) আকারের গ্যালাক্সি বলেন। ডিস্ক বা চাকতি আকারের এ গ্যালাক্সির কেন্দ্র স্ফীত, চারটি প্রধান বাহু আছে, আর আছে বাহুর কয়েকটি ছোট ছোট অংশ। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির প্রধান চারটি বাহুগুলোতে সবচেয়ে বেশি তারা অবস্থান করে। শার্পিল এই চারটি বাহুর নাম, সিগনাস, পারসিয়াস, সাজিট্যারিয়াস ও সেন্টরাস।
সূর্যসহ আমাদের সৌরজগৎ পারসিয়াস ও সাজিট্যারিয়াস বাহুদ্বয়ের মধ্যবর্তী ওরিয়ন নামক ছোট্ট বাহুর মধ্যে অবস্থিত। য’হোক, ছায়াপথ গ্যালাক্সির ব্যাস ১৫০০০০ থেকে ২০০০০০ আলোকবর্ষ। এই গ্যালাক্সিতে ১০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন তারা আছে। আর আছে ১০০ বিলিয়ন এক্সোপ্ল্যানেট বা গ্রহ। এক্সোপ্ল্যানেট হল, আমাদের সৌরজগতের বাইরের গ্রহ। ওই সব গ্রহ তাদের নিজস্ব তারার চারপাশে প্রদক্ষিণ করে। এক্সোপ্ল্যানেট বা সৌরজগতের বাইরের গ্রহ সাধারণতঃ ছোট, বড় এবং মাঝারি আকারের হয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা ওই সব গ্রহের কোন কোনটিতে পৃথিবীর মত প্রাণী আছে। ওই সব গ্রহের প্রাণী যে মানুষের মতই হবে তা’ কিন্তু নয়। ওসব গ্রহের প্রাণীর আকার, আকৃতি, প্রকৃতি বিভিন্ন রকম হতে পারে। ছায়াপথের একটি কোণায় অবস্থান করে আমাদের সৌর জগৎ। আমাদের সৌর জগৎ ছায়াপথের (মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির) কেন্দ্র থেকে ২৮০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। আমাদের পৃথিবী যেমন সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, তেমনই সূর্য তার সৌরজগৎ নিয়ে ছায়াপথের কেন্দ্রকে প্রতি ঘন্টায় প্রায় ৮২৮,০০০ কিলোমিটার বা প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২৩০ কিলোমিটার গতিতে প্রদক্ষিণ করে । এত দ্রুতগতিতে ঘুরেও সৌরজগতের নিজ কক্ষপথ ধরে ছায়াপথের কেন্দ্রকে একপাক দিতে প্রায় ২৩০,০০০,০০০ বছর সময় লাগে। এই লম্বা সময়কালকে মহাজাগতিক বছর বলা হয়। আমাদের সৌরজগৎ মিল্কিওয়ে বা ছায়াপথ গ্যালাক্সির সাজিট্যারিয়াস নামক বাহুর ওরিয়ন নামক ছোট্ট ডানায় অবস্থিত। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি নিজে প্রতি সেকেন্ড ১৬৮ মাইল গতিতে পরিভ্রমন করছে। মিল্কিওয়ের পাশের গ্যালাক্সির নাম অ্যান্ড্রোমেডা। বিজ্ঞানীরা মিল্কিওয়ে ও অ্যান্ড্রোমেডাসহ ৫০ গ্যালাক্সিকে লোকাল গ্রুপ বলে থাকেন। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এই গ্যালাক্সিগুলো কোন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে টিকে আছে। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির-অ্যান্ড্রোমেডা সংঘর্ষ বিজ্ঞানীরা আরোও মনে করেন, প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন বছর পরে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সাথে অ্যান্ড্রোমেডা গ্যালাক্সির সংঘর্ষ হবে এবং এই সংঘর্ষ ৫ বিলিয়ন বছর পর্যন্ত স্থায়ী হবে। একটি গ্যালাক্সি অন্যটির মধ্যে ঢুকে অতিক্রম করার সময় মাধ্যাকর্ষণ বলে তারা একটি অন্যটির সাথে আটকে যাবে। গ্যাক্সির আকার ও আকৃতির পরিবর্তন হবে এবং আরও বড় উপবৃত্তাকার মহাগ্যালাক্সিতে রূপান্তরিত হবে। একটির গ্যাস অন্যটির গ্যাসের সাথে একত্রিত হয়ে নূতন নূতন বিশাল নক্ষত্র গঠন করবে। ভয়ের কিছু নেই। ধবংস নয় সৃষ্টি হবে। আগেই বলেছি, ছায়াপথ ও অ্যান্ড্রোমেডার মধ্যে দূরত্ব ২.৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ এবং একে অন্যের দিকে প্রতি ঘন্টায় ৪০২,০০০ কিলোমিটার বেগে এগিয়ে যাচ্ছে। সে হিসেবে ছায়াপথ ও অ্যান্ড্রোমেডা চারশত কোটি বছরের আগে মিলিত হতে পারছে না। পৃথিবীর বয়স সাড়ে চারশত কোটি বছর, আর হোমোস্যাপিয়েন্স যাকে আমরা আধুনিক মানুষ বলি, তারা এসেছে ২/৩ লক্ষ বছর আগে। প্রথম দুই পায়ে হাঁটা প্রাণী পৃথিবীতে এসেছে ৭০ লক্ষ বছর আগে। মানুষের মত দুই পায়ে হাঁটা প্রাণী এসেছে ২০/৩০ লক্ষ বছর আগে। তা’হলে, ৪০০ কোটি বছর পড়ে কি হবে তা’ নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কি আছে? আসল কথা হল, ওই সংঘর্ষে কিছুই হবে না। (ছায়াপথ – চলবে)