নাজমুল হক বিলাস
জীবন ধারণের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান হচ্ছে খাদ্য। খাদ্য উৎপাদনের জন্য কৃষি কাজের বিকল্প নেই। কৃষি কাজ করা হয় ভুমি তথা মাটিতে। মাটিতে ফসল উৎপাদন করা হয় ফলে আমরা খাদ্য পাই।
মাটি যত ভাল থাকবে খাদ্য তত ভাল উৎপন্ন হবে। উপযুক্ত ফসলের জন্য চাই উপযুক্ত মাটি। আর মাটিকে উপযুক্ত করার জন্য চাই মাটির পরীক্ষা। কোন স্থানের মাটির পরীক্ষা দ্বারা জানা যায় এই মাটি ফসল ফলানোর জন্য কতটা উপযোগী, এখানকার মাটির ধরণ কি, বা কি প্রকারের, মাটির গুণাগুণ, জলীয় অবস্থা ইত্যাদি জানা সম্ভব। সেই সাথে আরও জানা যায় এই মাটিতে কি ধরণের ফসল ফলানো সম্ভব। মাটির উর্বরতা পরীক্ষা করা সম্ভব। অনুর্বর মাটিকে উর্বর করতে কি করতে হবে সে সম্বন্ধে ধারণা লাভ করা যায় মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে।
সবচেয়ে যে বিষয়টি জানা উচিত এবং জানা সম্ভব কেবল মাটি পরীক্ষার মাধ্যমেই তা হচ্ছে মাটির পিএইচ মান (pH value). পিএইচ মাটির একটি রাসায়নিক মান নির্দেশ করে যা জানা অত্যন্ত জরুরি। সাধারণত এই মান না জানার কারণে জমির প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠে না এবং চাষের ক্ষেত্রে কাঙ্খিত ফসল না প্রাপ্তির একটি বড় কারণ হয়ে থাকে। মূলত পিএইচ মান মাটির ক্ষারত্ব বা অম্লত্ব নির্দেশ করে। এর মান ০ থেকে ১৪ পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্রথম শূন্য থেকে ৭ পর্যন্ত অম্ল এবং ৭ এর বেশী থেকে ১৪ পর্যন্ত ক্ষারীয় মান নির্দেশ করে। মান ৭ হলে নিরপেক্ষ নির্দেশ করে।
মাটি ক্ষারীয় হলে সেখানে ভালো ফসল ফলানো সম্ভব নয়। মাটিতে অম্লের পরিমাণ বেশী হলেও সেখানে খুব ভালো ফসল পাওয়া যাবে না। অম্লের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত মাটির ভাল অবস্থা নির্দেশ করে। এর বেশী চাষের জন্য উপযোগী নয়। কাজেই সার্বিক কৃষি কাজের জন্য মাটির অম্লতা এবং ক্ষারীয় মান জানা একান্ত জরুরি যা কেবল মাটির পিএইচ মান দ্বারা জানা সম্ভব এবং পিএইচ মান ল্যাবরেটরিতে মাটি পরীক্ষার মাধ্যমেই জানা সম্ভব। মাটির পিএইচ মান থেকে অম্লতা বা ক্ষারত্ব নির্ধারণের পর যদি দেখা যায় এই মান অনেক বেশী যা চাষের উপযোগী নয় তারপরও চিন্তিত হওয়ার কোন কারণ নেই। কারণ এই মাটিকে বিভিন্ন রাষায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চাষের উপযোগী করা সম্ভব।
এখন কথা হচ্ছে এই মাটি পরীক্ষা কখন, কিভাবে, কোথায় করা যায়। প্রত্যেক দেশেই মাটি পরীক্ষার জন্য গবেষণাগার রয়েছে। সেখানেই মূলতঃ মাটি পরীক্ষা করা হয়। বাংলাদেশে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অধীনে মৃত্তিকা গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। এই কেন্দ্রেই মাটি পরীক্ষা হয়ে থাকে। সারা দেশে এর শাখা অফিস রয়েছে যা জেলা কৃষি বিভাগের অধীনস্থ। কোন ব্যক্তি তার জমির মাটি পরীক্ষার জন্য বছরের যে কোনো সময় জেলা কৃষি অফিসে দেখা করতে পারে। জেলা কৃষি কর্মকর্তার দ্বায়িত্ব সেই ব্যক্তিকে সম্পূর্ণরূপে সাহায্য করা। জমির কোন কোন স্থান থেকে মাটি সংগ্রহ করে জমা দিতে হবে এসব কিছু বুঝিয়ে দেওয়া। প্রয়োজনে কর্মকর্তাদের উচিত সরাসরি জমিতে উপস্থিত হয়ে পর্যবেক্ষণ করা ও মাটি সংগ্রহ করা। সঠিক ও উত্তম ফসলের জন্য এবং দেশের মানুষের স্বার্থে এই কাজ তাদের দ্বায়িত্ব নিয়ে করা কর্তব্য।
সঠিক উপায় মাটি সংগ্রহের পর এই মাটি মৃত্তিকা গবেষণাগারে পাঠানো হয় এবং কিছু দিনের মধ্যে ফলাফল এসে যায়। গবেষণা ফলাফলে মাটির যাবতীয় তথ্য উল্লেখ থাকে। জেলা কৃষি কর্মকর্তার আরো দ্বায়িত্ব হল উক্ত কৃষককে সমস্ত রিপোর্ট বুঝিয়ে বলা। যদি উর্বরতা ঠিক থাকে এবং মাটির পিএইচ মান সঠিক পর্যায়ে থাকে তবে কি কাজ করতে হবে বা কোন ফসল ভাল হবে, কি ধরণের সার প্রয়োগ সঠিক হবে এ সমস্ত তথ্য কৃষককে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। অপরদিকে জমি যদি অনুর্বর হয় অথবা পিএইচ মান সঠিক পর্যায় না থাকে তাহলে কীভাবে এই জমিকে উর্বর করা যায় এবং পিএইচ মান সঠিক পর্যায়ে আনা যায় সে সম্পর্কে সমস্ত তথ্য ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। কৃষক কি ধরনের ফসল চাষ করতে ইচ্ছুক, সেখানে সেই ফসল চাষ সম্ভব কিনা এবং সম্ভব না হলে কি প্রক্রিয়ায় সম্ভব করা যায় সেই সকল তথ্য কৃষককে বুঝিয়ে একান্ত উচিত অথবা যে ফসল চাষ করলে ভালো ফল লাভ করা যাবে সেই বিষয়ে বুঝিয়ে বলা উচিত। যিনি কৃষক তার মাটি পরীক্ষার সমস্ত বিষয় বস্তু জানা থাকবে অথবা পরীক্ষার উপকরণ বা ল্যাবরেটরি তার কাছে থাকবে এমন টা নয় বা আশা করাও যায় না। এই সকল দ্বায়িত্ব রাষ্ট্রের কৃষি বিভাগকেই নিতে হবে।
সাধারণত প্রতি দু’বছর পর পর একবার মাটি পরীক্ষা করলে ভাল হয়। সম্ভব না হলে অন্তত পাঁচ বছরের মধ্যে একবার মাটি পরীক্ষা করা উচিত। কখনো কখনো দেখা যায় কয়েক বছর ফসল ভাল হওয়ার পর পরের কয়েক বছর ফসল ভাল হচ্ছে না। সেই সময় অবশ্যই উচিত একবার মাটি পরীক্ষা করা। তাহলে প্রকৃত কারণ জানা যাবে। শুধু যে জমিতে ফসল চাষের জন্যই মাটি পরীক্ষা করতে হবে এমনটা নয়, মাছ চাষের জন্য পুকুর খনন করার পূর্বে মাটি পরীক্ষা করে প্রকৃত অবস্থা জেনে নেওয়া যায়। এর ফলে পুকুরের অবস্থা ভাল থাকে ও মাছ চাষে ভাল ফল লাভ করা যায়।
মৃত্তিকা গবেষণাগারে মাটির সাধারণ পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু আরো অধিক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা করার জন্য বা জটিল পরীক্ষার জন্য এই গবেষণাগার যথেষ্ট নয়। এই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা যেখানে মাটির অনু পরমানু নিয়ে কাজ করা হয় সেই পরীক্ষার জন্য পারমাণবিক শক্তি গবেষণাগার রয়েছে। সেখানে রেডিয়েশনের মাধ্যমে মাটির ভেতরকার প্রকৃত অবস্থা জানা সম্ভব হয়। সেই সাথে পারমাণবিক পদ্ধতিতে মাটিকে কৃষি উপযোগী করার ব্যবস্থা রয়েছে।
মাটি পরীক্ষার আরও একটি বড় সুফল হচ্ছে, মাটি কৃষি উপযোগী করে নিয়ে ফসল চাষ করলে কৃষির উৎপাদন খরচ অনেক কমে যায়। যেমন সার কীটনাশক ইত্যাদির প্রয়োজন কম হতে পারে ফলে খরচ কমে যেতে পারে, উৎপাদন সময় কমে যেতে পারে, ফলে কৃষক কম খরচে ফসল উৎপন্ন করে কম দামে বিক্রি করলেও লাভ থেকে যায় এবং সাধারন মানুষ কম খরচে খাদ্য ক্রয় করতে পারে ফলে ভোক্তা ও কৃষক উভয় পক্ষের প্রচুর অর্থ সাশ্রয় হতে পারে।
খাদ্য মানুষের গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা। জীবনের জন্য খাদ্য প্রয়োজন। খাদ্য যত বেশি উৎপন্ন হবে খাদ্য ঘাটতি তত কম হবে এবং দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। আমাদের দেশ আয়তনে ক্ষুদ্র কিন্তু সেই তুলনায় মানুষ অনেক বেশি। কাজেই অল্প জায়গায় অধিক ফসল উৎপাদনের পরিকল্পনা করতে হচ্ছে। আর এর জন্য মাটি পরীক্ষার বিকল্প নেই। মাটি পরীক্ষার মাধ্যমেই মাটির প্রকৃত অবস্থা জেনে কৃষি কাজের ব্যবস্থা নেওয়া হলে ভাল ফল লাভ করা যাবে এবং দেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে।
লেখাটি পড়ে ও প্রকাশ হয়েছে জেনে খুব ভাল লাগল